একটি রোবট হাত

Posted by Admin | 10:29 PM

গত বছরের শেষ দিকের কথা। টেলিভিশনে ইন্টেলের ডুয়েল কোর প্রসেসরের একটি বিজ্ঞাপন চলছে। সেখানে দেখা গেল, নানা রকমের কৃত্রিম বা রোবট হাত সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ঝালাই, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের পিসিবি বোর্ড তৈরি, নকশা ইত্যাদি কাজ নিখুঁতভাবে করে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হলো, এত সুন্দর রোবট হাত যদি আমাদের দেশেও তৈরি করা যেত, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আরও অনেক দুর এগিয়ে যেতে পারতাম। স্বপ্নও নাকি মাঝেমধ্যে সত্য হয়। এর কয়েক দিন পরই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সপ্তম আইসিএমই (ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) ২০০৭-এর প্রকল্প প্রদর্শনীতে একদল শিক্ষার্থী ইন্টেলের এই রোবট হাতের মতোই সুন্দর ও কার্যকর একটি রোবট হাত তৈরি করেছেন। হাতটি তুলতে পারে সেভেনআপ বা কোকা-কোলার বোতল; সামনে-পেছনে, ওপরে-নিচে খুব সুন্দর করে নড়াচড়া করতে পারে; ধরতে পারে যেকোনো জিনিস−এমনকি আপনি চাইলে করমর্দনও করতে পারেন এই আধুনিক, চৌকস রোবট হাতের সঙ্গে। আর এই বুদ্ধিমান কৃত্রিম হাতের নির্মাতারা বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আক্তারুজ্জামান আমান, মামুনুর রহমান, আফরিন অণু, ফারজানা রহমান স্বর্ণা ও শহীদ মজুমদার। তাঁরা এই রোবট হাতের নাম দিয়েছেন আর্মবোট।


প্রারম্ভের কথা
বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের ছয় মাস ধরে একটি প্রকল্প দাঁড় করাতে হয়, যেখানে দেশের ভবিষ্যৎ যন্ত্রকৌশলীরা তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, নকশা, সময়ের প্রয়োজনীয়তা, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রয়োগ উপস্থাপন করেন। যন্ত্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান মামুন আমানদের দলটিকে বলেন সিএনসি (কম্পিউটার নিউমেরিক কন্ট্রোল) যন্ত্র বা রোবট হাত তৈরি করতে। আমানেরা রোবট হাতই বেছে নেন। সেমিস্টারের শুরুতে একটু ঢিমেতেতালায় কাটালেও মাঝামাঝি এসে তাঁরা কাজের প্রতি বেশি করে মনোযোগ দেন। সপ্তাহখানেক খেটে শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি নকশা দাঁড় করিয়ে ফেলেন। নকশা করার জন্য তাঁরা বেছে নেন প্রকৌশল অঙ্কনের সফটওয়্যার অটোক্যাড। তবে একবারেই এ নকশা সফল হয়নি; নানা রকম নকশা করে সেগুলোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিশীলন ও নিত্যনতুন ধারণার সমন্বয়েই চুড়ান্ত হয় মূল নকশা।


এবার যন্ত্র তৈরির পালা
হাতের কথা যেহেতু বলা হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই আঙ্গুলের কথা চলে আসে। আর আমানদের ভাষায়, আঙ্গুলের নকশা করাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। কারণ, কোনো জিনিস তুলতে গেলে ভরটা এসে পড়ে আঙ্গুলের সঙ্গে থাকা হাতের জোড়ে। আঙ্গুলের নকশা ও বল হিসাব করার পর তাঁরা ঠিক করেন, অ্যালুমিনিয়াম, মাইল্ড স্টিল (এমএস রড), ইস্পাত, কাঠ, সুতা আর নাইলন দিয়েই তৈরি হবে এই রোবট হাত। তবে এই মালপত্র জোগাড় করতে আমানদের বেশ কষ্টও পোহাতে হয়। প্রথমে অ্যাক্রিলিক পাতের কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। কিন্তু পরে জানতে পারলেন, অ্যাক্রিলিক পাত আঠায় জোড়া লাগে না। আবার যেমন অ্যালুমিনিয়াম পাত ওয়েল্ডিং করা যায় না বলে অ্যালুমিনিয়াম পাত বাদ দিলেন (পরে অবশ্য জানতে পারলেন, অ্যালুমিনিয়াম পাত জোড়া দেওয়া যায়, তবে সেটার নাম ওয়েল্ডিং নয়, ব্রেজিং)। যা হোক, অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়েই নবাবপুর রোড, ধোলাইখাল থেকে নতুন-পুরোনো, ব্যবহূত মালমসলা দিয়ে বুয়েটের ওয়েল্ডিং শপ, মেশিন শপ ও কার্পেন্ট্রি শপে রোবট তৈরির কাজ চলতে থাকে। টানা দেড় মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর দাঁড়িয়ে যায় রোবটের কাঠামো।


রোবটের নিউক্লিয়াস
আমান, অণু, মামুন, শহিদ ও স্বর্ণারা তাঁদের রোবট হাত চালানোর জন্য চারটি ডিসি গিয়ার সেট ব্যবহার করে এগুলোর মধ্যে একটি মোটর ব্যবহার করেন। এই মোটর পুরো কাঠামোটিকে গাড়ির মতো চালানোর কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। বাকি তিনটির মধ্যে একটি হাতের নিয়ন্ত্রণ এবং দুটি আঙ্গুলের নাড়াচাড়ায় নিয়োজিত। এই মুহুর্তে এ রোটের নিয়ন্ত্রণের অনেকখানিই ম্যানুয়াল। ডিপিডিটি সুইচের (ডবল পোল ডবল থ্রো) মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণের কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। এখন হাতটি দুই কিলোগ্রাম ওজনের বস্তু অনায়াসে তুলতে পারে। আরেকটি কথা, রোবট হাতের ডিগ্রি অব ফ্রিডমের সংখ্যা ৪। এর মধ্যে দুটি অনুভুমিক ও লম্বিক এবং বাকি দুটি ঘুর্ণন। ফলে জায়গায় দাঁড়িয়ে হাতটিকে বাড়িয়ে দিয়ে বা নির্দেশমতো কোথাও গিয়ে ভালোভাবেই পেপসির বোতল, গ্লাস, বল, খেলনা ইত্যাদি তুলে নিতে পারে আর্মবোট।


তাঁদের কথা
আমান, মামুন, স্বর্ণা, অণু, শহীদ−সবাই এখন তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে। প্রত্যেকেরই স্বপ্ন ভবিষ্যতে দক্ষ যন্ত্রকৌশলী হওয়া এবং ভালো কিছু করা। রোবট-বিজ্ঞানের এই কাজটির মাধ্যমে তাঁরা প্রযুক্তি ও জ্ঞানের এই অভিনব মিশেলকে আয়ত্ত করার পাশাপাশি আর্মবোটের নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা ও উপযোগিতা বাড়ানোর জন্যও কাজ শুরু করেছেন। যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জহুরুল হকের তত্ত্বাবধানে আর্মবোটের প্রধান নকশাবিদ আক্তারুজ্জামান আমান এর উন্নত সংস্করণ ও অধিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ শুরু করেছেন।আঙ্গুলের পরিচালনা আরও সহজ ও শক্তিশালী কীভাবে করা যায়, আর্মবোটের নিয়ন্ত্রণ মাইক্রোকন্ট্রোলারের মাধ্যমে করা, আরও বেশি দ্রুত কীভাবে করা যায়−সেগুলোর গবেষণাই চলছে এখন। তবে একটি অভিযোগ তাঁরা সবাই জানালেন−প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়াল ও মেশিনিংয়ের প্রযুক্তির অভাব। আমান বললেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম রোবটের ছোট-বড় সফল ডাইমেনশন বা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নিখুঁত করতে; কিন্তু প্রয়োজনীয় মেশিনিং প্রযুক্তি না থাকায় আমরা পারিনি।’


আমাদের আশা
শুরুতেই বলেছিলাম শিল্পক্ষেত্রে রোবট হাতের ব্যবহারের কথা। মানুষের জন্য কৃত্রিম পা বা হাত তো ব্যবহূত হচ্ছে বহু আগে থেকেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহ আর্মবোটটি দেখে বলেছিলেন, এটি আরেকটু বড় ও শক্ত হলে র‌্যাংগস ভবন ভাঙতে ব্যবহার করা যেত। আর এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া তো রীতিমতো যুদ্ধ করছে সত্যিকারের মানুষের হাতের মতো রোবট হাত তৈরির জন্য; যে হাতের পরিচালন, সঞ্চালন, নিয়ন্ত্রণ−সবই হবে একেবারে মানুষের হাতের মতো; যে হাত চলবে একই সঙ্গে কার্তেসীয় পোলার স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায়−যেকোনো দিকে যেকোনো ভাবে আঙ্গুল পরিচালনা করা যাবে। ড. জহুরুল হকের ভাষায়, ‘রোবোআর্মের এ প্রযুক্তি পুরোপুরি আয়ত্ত করতে হয়তো ১০০ বছর লেগে যাবে, কিন্তু শিল্পক্ষেত্রে রোবট হাতের ব্যবহার আমাদের দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিনিয়োগকারীরা একটু সচেতন, উদ্যমী ও সমন্বিত হলে এখনই শুরু করা সম্ভব। এ জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেক উৎসাহ দিতে হবে, তাঁদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে−যেন তাঁরা তাঁদের মেধাকে দেশের জন্য পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারেন।’আর্মবোট তৈরিতে এই দলটিকে প্রায়ই সাহায্য করেছেন বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক মো. আল-আমিন খান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের জন্য রোবট হাত খুব উন্নতমানের একটি প্রকল্প। তারা যে অধ্যবসায় ও গবেষণা করেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এ ধরনের প্রজেক্টকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার।’আমরাও সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন সত্যি সত্যি আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলবেন। আর সেই সুদিনের পথে এই আর্মবোট নিশ্চয়ই বড় একটি পাথেয় হয়ে থাকবে।