ছোট্ট বানরগুলোর কানে লোমের গোছা আর পেছনে জেব্রার মতো ডোরা দাগ। ব্রাজিলের আমাজনের জঙ্গলে এক অভিযানের সময় সুইজারল্যান্ডের জীববিদ মার্কো সুয়ার্তজ যখন প্রথম দেখেন এদের, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, এগুলো পরিচিত কোনো প্রাণী নয়। ফলের টোপ দিয়ে ফাঁদ পেতে কোনো ধরনের ক্ষতি না করেই বিরল এসব বানরের কয়েকটি তিনি আটকে ফেললেন পরীক্ষার জন্য। পরে তিনি এবং আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ একে মারমোসেটের (মারমোসেট পড়েছে বানর পরিবারেই) এমন একটা প্রজাতি হিসেবে শনাক্ত করলেন, যা আগে কখনো চোখেও দেখেননি বিজ্ঞানীরা। যে নদীর ধারে সুয়ার্তজ এদের আবিষ্ককার করেছেন, তার নাম অনুসারে এখন এই বানরদের নাম রাখা হয়েছে রিও মাওয়েস মারমোসেট।আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ পৃথিবীতে কত প্রজাতির প্রাণীর বাস, তার চেয়ে আকাশে কতগুলো তারা জ্বলজ্বল করে, সে সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন বিজ্ঞানীরা। প্রতিদিনই আবিষ্ককৃত হচ্ছে নতুন প্রজাতির প্রাণী; যার বেশির ভাগই পোকামাকড়, ক্রিমিসহ এমনই ছোট প্রজাতির সব প্রাণী যে খুব কম লোকই খেয়াল করে এদের। নতুন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর খোঁজ মেলে একেবারেই কালেভদ্রে। এমনই এক ধরনের বুনো মহিষজাতীয় এশীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী সাওলা। ভিয়েতনামের প্রত্যন্ত এক গ্রামের একটি বাড়িতে অদ্ভুত ধরনের কয়েকটি শিং ঝোলানো দেখে কৌতুহলী হয়ে এ প্রাণীটি খুঁজে বের করেন দুজন জীববিদ। বিজ্ঞানীদের কাছে সাওলা সম্পুর্ণ নতুন একটি প্রাণী হলেও স্থানীয় লোকদের কাছে মোটেই অপরিচিত নয়। তারা এর অস্তিত্বের কথা জানে। তারা এটাও জানে, প্রাণীটির দেখা মেলে কালেভদ্রে।অনেক সময় স্থানীয় বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন বন্য প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে কোনো প্রাণী সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানীরা। আর অনেক ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে আবিষ্ককৃত হয় সম্পুর্ণ নতুন প্রজাতির কোনো প্রাণী; যেমনটি ঘটেছে খুদে ঠোঁটের তিমিদের ক্ষেত্রে। পেরুর মাছের বাজারে খোঁজ পাওয়া এদের শরীরের বিভিন্ন খন্ডাংশ নতুন প্রজাতির একটি তিমি হিসেবে শনাক্ত করতে সাহায্য করে বিজ্ঞানীদের। লাওসের লাক জাওসহ এশিয়ার বিভিন্ন দুর্গম গ্রামেও মাঝেমধ্যে এ রকম বিভিন্ন অচেনা প্রাণীর মাংস কিংবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচাকেনা হতে দেখা যায়।নতুন কোনো প্রজাতির প্রাণীর খোঁজ করার সময় অনেকাংশেই স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর নির্ভর করেন বিজ্ঞানীরা। ওলন্দাজ বিজ্ঞানী মার্ক ভ্যান রুজমালেন যখন ব্রাজিল সফরে যান, তখন সেখানকার এক গ্রামবাসী কফির একটি বাক্সে পুরে জীবিত একটি কালো-মুকুট বামন মারমোসেট নিয়ে আসে তাঁর কাছে। প্রাণীটি দেখেই তিনি বুঝে ফেলেন, এটা তাঁর সম্পুর্ণ অপরিচিত নতুন কোনো প্রজাতির প্রাণী। তবে এটা যে বিজ্ঞানের কাছে সম্পুর্ণ অপরিচিত একটা প্রজাতি, তা প্রমাণ করতে ইঁদুর আকারের এসব বানরের আরও কয়েকটি নমুনার প্রয়োজন পড়ে তাঁর। আর এগুলোর খোঁজে এক বছরেরও বেশি সময় কাটাতে হয়েছে তাঁকে আমাজনের গহিন জঙ্গলে। এই বামন মারমোসেটরা এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম বানর।ব্রাজিলে ইদানীং অনেক নতুন প্রজাতির বন্য প্রাণীর খোঁজ পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এমনই আরেকটি প্রাণী কালমুখো লায়ন তামারিন। এগুলো প্রথম শনাক্ত করা হয় ব্রাজিলের এক দ্বীপের রেইন ফরেস্টে। সর্বশেষ গত বছর ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্ব আমাজনের রিও এরিপুয়ানার বেসিনে বিজ্ঞানীরা আবিষ্ককার করেছেন শুকরসদৃশ প্রাণী পোকারিদের সম্পুর্ণ নতুন একটি প্রজাতি। পোকারি মেক্সিমাস নাম পাওয়া এ পোকারিগুলো এত দিনের পরিচিত পোকারিদের চেয়ে আকারে বড়। এগুলোর আচার-আচরণও ভিন্ন। পোকারিগুলো সাধারণত বড় দলে থাকতে পছন্দ করে; কোনো কোনো দলে সদস্যসংখ্যা অনেক সময় এক শ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এগুলো থাকে জোড়া বেঁধে। বড়জোর সঙ্গে থাকে গোটা দুয়েক বাচ্চা। তবে বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন এ পোকারিগুলো স্থানীয় ইন্ডিয়ানরা চেনে অনেক আগে থেকেই। টুপি ইন্ডিয়ানরা এগুলোকে ডাকে "কেইতেতু মুন্দি" নামে, যার অর্থ বিশাল পোকারি; থাকে জোড়া বেঁধে।ব্রাজিলের গহিন অরণ্যগুলোর পাশাপাশি এশিয়ার জঙ্গলেও কিন্তু নতুন প্রজাতির বন্য প্রাণী আবিষ্ককৃত হচ্ছে। ফিলিপাইনের পেনি দ্বীপের বৃক্ষে দেখা মিলবে দ্য পেনি ক্লাউডরানারদের। বিশ শতকের শেষ ভাগে প্রথম বৃক্ষচর, নিশাচর এ ইঁদুরগুলোর কথা জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা। এদিকে লিনাস সানবার্ড নামের যে বর্ণিল ছোট্ট পাখিটি শনাক্ত করা হয় ১৯৯৭ সালে, তার নিবাসও কিন্তু ফিলিপাইনে। ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ বোর্নিওর কেট-ফক্স নাইট-ক্যামেরার ফাঁদে এটি প্রথম আটকা পড়ে ২০০৩ সালে। আকৃতিতে এগুলো বিড়ালের চেয়ে সামান্য বড়−গায়ে লাল পশম, দীর্ঘ লেজ এবং সামনের পা পেছনের পায়ের চেয়ে বড়। বলা চলে, এটির পুরো চেহারা বিড়াল আর শিয়ালের মাঝামাঝি। ফাঁদ পেতে এগুলোর অন্তত একটি নমুনা ধরে গবেষণা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কেট-ফক্স যে সত্যি সত্যি নতুন একটি প্রজাতি, তা প্রমাণ করা গেলে এটি হবে ১৮৯৫ সালের পর বোর্নিও দ্বীপে আবার কোনো নতুন প্রজাতির মাংসাশী প্রাণীর আবিষ্ককার।অবশ্য ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, যে প্রাণীর ছবি তোলা হয়েছে, এটা মাংসাশী প্রাণী নয়, বরং এ এলাকায় দেখা পাওয়া বিশালাকৃতির উড়ন্ত কাঠবিড়ালীর একটি প্রজাতি এবং সম্ভবত প্রাণীটি থমাস ফ্লাই স্কুইরাল। আবার কেউ কেউ দাবি করছেন, এটি আসলে কালেভদ্রে এখানকার জঙ্গলে চোখে পড়া এক জাতের পাম সিভেট। নতুন আবিষ্ককৃত বেশির ভাগ প্রাণীই বিপন্ন প্রজাতির হওয়ায় এগুলো শনাক্ত করাটাও অনেক সময় হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। কারণ, নতুন আবিষ্ককৃত প্রাণীর জীবিত নমুনার ব্যাপক চাহিদা থাকে। আর ফাঁদে ধরার সময় প্রায়ই মৃত্যুও হয় এদের। তবে এই আবিষ্ককার অনেক সময় প্রাণীটির উপকারেও আসে। যেমন−সাওলা আবিষ্ককারের পর এগুলোর বসবাসের অঞ্চলটা সংরক্ষিত এলাকার আওতায় নিয়ে এসেছে ভিয়েতনাম ও লাওস সরকার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভবিষ্যৎ আরও নিরাপদ হবে বিপন্ন এ প্রাণীটির।শেষ করছি উত্তর আমেরিকায় আবিষ্ককৃত এক ধরনের জেলি ফিশের সংবাদ দিয়ে। পানিতে ভেসে সেখানকার পশ্চিম উপকুলে ভেড়ার আগে গোলাপি রঙের আশ্চর্য সুন্দর চেহারার বিশালদেহী জেলি ফিশগুলো (জায়ান্ট জেলি) আগে কখনো দেখেননি পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা।