পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ গলছে প্রতিনিয়ত। আর এ কারণে ভয়ঙ্কর এক অবস্থার দিকে যাচ্ছে মানব সভ্যতা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে একটু একটু করে। আর পানির উচ্চতা বাড়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে বাংলাদেশসহ সমুদ্র-তীরবর্তী অনেক দেশ। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপ লড়ছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। পরিস্িথতি তাদের বিকল্প ভুখন্ড নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। বরফ গলার জন্য দায়ী পৃথিবীর গড় উষ্ণতার ক্রমবর্ধমান গতি। আর সবকিছুর মূলে আছে পরিবেশদুষণ। এ অবস্থার সবচেয়ে বাজে শিকার উন্নয়নশীল দেশগুলো হলেও পরিবেশদুষণের জন্য বেশি দায়ী কিন্তু শিল্পোন্নত দেশগুলো। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও কম নয়। সবকিছুর পরও সারা বিশ্বের মানুষ এখন এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের আশায় একসঙ্গে কাজ করছে; করতে বাধ্য হচ্ছে টিকে থাকার জন্য। ভয়ঙ্কর এই বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পরিবেশদুষণ কমানো ছাড়াও বিকল্প পথগুলো নিয়ে ভাবছে সবাই। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী দীর্ঘ গবেষণার পর বরফ গলার ধরন এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য আবিষ্ককার করতে পেরেছেন। তাঁরা জানতে পেরেছেন ঠিক কোন সময় এবং কী অবস্থায় বরফ গলা শুরু হয়। বিশেষ করে বরফের স্তুপ থেকে ছোট টুকরোগুলো কীভাবে ভেঙে আলাদা হয়, তা আবিষ্ককার করেছেন তাঁরা। বরফের টুকরোর আলাদা হওয়ার বৈশিষ্ট্য থেকে তাঁরা চমৎকার কিছু তথ্য পেয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন যে শুধু উষ্ণতাই বরফ গলার একমাত্র কারণ নয়। বরফের স্তুপ থেকে ছোট টুকরো আলাদা হওয়ার পেছনে চাপসহ বেশ কিছু পারিপার্শ্বকি অবস্থাও কাজ করে। সে জন্যই অনেক সময় দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত শীতল জায়গায়ও বরফ গলার হার বেশি থাকে। বিজ্ঞানীরা এসব কারণ উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছেন। তাঁরা আশা করছেন, এসব কারণ জানা সম্ভব হলে বরফের টুকরো আলাদা হওয়ার গতি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে।বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বরফের বড় স্তুপ থেকে বরফ গলা পানির চেয়ে একই আয়তনের বেশি সংখ্যক টুকরো থেকে গলা পানির পরিমাণ অনেক বেশি হয়। তাই বরফের স্তুপ ভাঙা কমানো গেলে বরফ গলা কিছুটা হলেও কমানো যাবে। আর বরফ গলার পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্য স্তুপের আকার ও পারিপার্শ্বকি অবস্থার ওপর নির্ভর করে। মেরু অঞ্চলে ৫০০ মাইল দীর্ঘ বরফের স্তুপ যেমন আছে, তেমনি মাত্র কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ স্তুপও আছে। সম্প্রতি দেখা গেছে, বরফের স্তুপের গড় আকার কমে আসছে দিন দিন। আর সে কারণেই উৎকন্ঠা বাড়ছে।পৃথিবীর উষ্ণতা পরিবর্তনের বহুমুখী প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তনের ফলে খরা ও বন্যা বাড়বে। দেখা দেবে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া। এর মধ্যে বন্যার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যার প্রকোপ বাড়বে−পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা আগেই এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা বলছেন, তাঁরা যে ঝুঁকির কথা ভেবেছিলেন, প্রকৃত ঝুঁকি তার চেয়ে অনেক বেশি হবে। বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার-এর এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের এই ভয়ঙ্কর প্রভাবের কথা নতুন করে বলা হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যার ঝুঁকির যে হিসাব আগে বের করা হয়েছিল, তাতে উদ্ভিদের ওপর কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রভাবের কথা আমলে নেওয়া হয়নি। কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস বাড়লে উদ্ভিদের ভুমি থেকে পানি শোষণ করে তা বায়ুমন্ডলে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। আর এর প্রভাবও পড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায়।সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। এ জন্য সমুদ্রের উপকুলবর্তী নিম্নাঞ্চলসমূহ ক্রমেই বেশি করে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের উপকুলেও লক্ষ করা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এর ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১৫ শতাংশ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে পারে। তার মানে, এক কোটির বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল হারাবে। বিশ্বে জমে থাকা সব বরফ যদি গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬০ মিটারের বেশি বেড়ে যাবে। আর এর প্রভাবে পৃথিবীর সমতল ভুমির প্রায় পুরোটাই তলিয়ে যাবে পানিতে। আর এখন যে হারে বরফ গলছে, সেভাবে চলতে থাকলে এই শতকে ১৮ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখেছেন, বর্তমানের মতো কার্বন ডাই-অক্সাইড আগে কখনো বায়ুমন্ডলে ছিল না। একইভাবে তাপমাত্রাও বেড়ে চলেছে। এর ফলে শুধু মেরু অঞ্চল বা পর্বতশীর্ষে জমে থাকা বরফই গলছে না, পৃথিবীর আবহাওয়াও ক্রমেই অস্িথর, অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। গ্রীষ্ক্নমন্ডলীয় অঞ্চলে মৌসুমি ঝড়ের তীব্রতা ও স্িথতিকাল বেড়ে যাচ্ছে। টর্নেডো, সাইক্লোনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে। সাগরের স্রোতের গতিবিধি বদলে যাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাতের তারতম্য হচ্ছে। শুধু মেরু অঞ্চলের বরফই গলছে, তা নয়; শীতপ্রধান অঞ্চলের যেসব নদী বা হ্রদে বরফ জমত, সেগুলোও এখন আগেভাগেই গলে যেতে শুরু করেছে। ফলে সেসব এলাকার প্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর পরিবর্তিত আবহাওয়ার প্রভাব পড়ছে। এরই মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রাণিজগতের অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে চলে গেছে, অনেকেই লড়ছে অস্তিত্বের প্রশ্নে। বিজ্ঞানীরা এখন নিশ্চিতভাবে জানাচ্ছেন যে গত তিন দশকে পৃথিবীর পরিবেশে যে পরিবর্তন এসেছে এবং প্রাকৃতিক ও জৈব ব্যবস্থা যেভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, তার জন্য মানুষই দায়ী। আর বেঁচে থাকার প্রশ্নে এ জন্য আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।