মৃত্যু মানুষের নিয়তি এবং বিধাতার সৃষ্ট নিয়ম। স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি মানুষ মৃত্যুবরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যদি মানুষের বিনোদনের কারণে ঘটে তবে মেনে নেয়া একটু কষ্টকর বৈকি। সম্প্রতি এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে থাইল্যান্ডে। ‘গ্রান্ড থিফট অটো’ এই ভিডিও গেমটি খেলতে গিয়ে এক থাই টিনএজার এমনই আসক্ত হয়ে পড়ে যে গেমটির হুবহু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সত্যি সত্যিই এক ট্রাক্সি ড্রাইভারকে খুন করে ফেলে। আর এই ঘটনার পর ভিডিও গেমটির পরিবেশক কোম্পানি গেমটি বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে হলেও সত্য, পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে তরুণটির মানসিক ভারসাম্যহীনতার কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি এবং সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সে খুব স্বাভাবিকভাবে দিয়েছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে তরুণটি যে জঘন্য কাজটি করেছে তা সে ভিডিও গেমটি খেলার পরে সৃষ্ট ঘোর থেকেই করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে সে মনে করেছে গেমটি যেহেতু এভাবে খেলার নিয়ম তাই বাস্তবেও এমনটি হয়তো করা যায়। সংশ্লিষ্টগণ মনে করছেন এ ব্যাপারটি থেকেই সম্ভবত তরুণটি এমন আচরণ করেছে এবং সে চিন্তাও করে দেখেনি যে সে কি করতে যাচ্ছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সে আসলে ব্যাপারটি এমনভাবে মনে করেছিলো যে এটা ভিডিও গেমের মতই সহজ এবং বাস্তবেও সে ওরকম একজন ভিকটিম খুঁজে বের করতে চেয়েছিল। ছেলেটির বাবা-মা জানিয়েছেন, সে খুবই শান্ত এবং ভদ্র ছেলে। তাদের ছেলে যে এরকম একটি কাজ করবে সেটা তারা কল্পনাও করেনি। ভিডিও গেমের ক্ষতিকারক প্রভাবের কারণেই এমনটি হয়েছে বলে তারা মনে করছেন। এ ঘটনার সাথে সাথেই ছেলেটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সে সময় ছেলেটি চলন্ত ক্যাব নিজেই নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ব্যাংককের রাস্তার বাইরে চালাতে শুরু করে। ছেলেটি মনে করছে যে সে কোন কিছু মনে করে ড্রাইভারকে খুন করেনি, সে তার বয়সের কারণেই ড্রাইভারকে একজন সম্ভাব্য ভিকটিম হিসেবে বাছাই করেছিল। ‘গ্রান্ড থিফট অটো’ এখন ফোর্থ এডিশনেও পাওয়া যাচ্ছে। এ গেমটি ইতিমধ্যেই ভায়োলেন্সের কারণে ব্যাপক বদনাম কামিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গাড়ি হাইজ্যাক, ড্রাইভ বাই শুটিং, ড্রাংক ড্রাইভিং এবং পতিতাবৃত্তি। থাইল্যান্ডের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই হত্যাকান্ডটি আমাদের সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে যে, আমরা কিভাবে এই ব্যাপারটি মোকাবেলা করব এবং অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে যে তাদের সন্তানরা কি খেলছে। এ সময়ে বোমা আসলেই ফেটেছে। তবে ভিডিও গেমসে নয়, বাস্তবে। কারণ আজকে ক্যাব ড্রাইভার মারা গেছে, কাল হয়তো খোদ ভিডিও গেম দোকানের মালিকই মরতে পারে। থাই মিনিস্ট্রি এখন এ ধরনের গেমের উপর কড়া নজর রাখছে এবং চেষ্টা করছে যাতে এ ধরনের ঘটনা পুনরায় না ঘটে। এ জন্য তারা গেমস বিক্রির উপর রেটিং সিস্টেম চালু করছে এবং পাবলিক প্লেসে কিশোর, তরুণদের গেম খেলার উপর সময় নিয়ন্ত্রণ করে দিয়েছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৫ সালে এই একই গেমের তৈরিকারক ও পরিবেশকদের উপর একটি মাল্টি-মিলিয়ন ডলারের মামলা করা হয়েছিল। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল এই গেমটির ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে একজন টিনেজার দুইজন পুলিশ অফিসারকে খুন করেছিল। এই ব্লকবাস্টার ‘গ্রান্ড থিফট অটো’ গেমসটি পাবলিশড করেছিলো ন্যাসডাক-লিস্টেড টেক-টু ইন্টারএকটিভ সফটওয়্যার। যাই হোক, এই থাই তরুণটির বয়স ১৮ বছর এবং সে হাই স্কুলের ছাত্র। বর্তমানে সে বিস্তারিত তদন্তের জন্য পুলিশী হেফাজতে রয়েছে। ৫৪ বছর বয়স্ক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সে ছুরি দ্বারা আঘাত করে হত্যা করেছে, যদি এটা প্রমাণিত হয় তবে তার জন্য লেথাল ইনজেকশনের মাধ্যমে মৃত্যু অপেক্ষা করছে। এদিকে থাই সরকারের মত ব্রিটেনও কম্পিউটার গেমসের জন্য সিনেমা স্টাইলে রেটিং এর সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে। যাতে করে বাচ্চাদেরকে ভিডিও গেমসে ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাওয়া ভায়োলেন্স থেকে রক্ষা করা যায়। ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক মন্ত্রী মার্গারেট হজ বলেছেন, ক্রমাগতভাবে ভিডিও গেমসে অ্যাডাল্ট থিম বেড়ে যাচ্ছে এবং অ্যাডভান্স গ্রাফিক্স ব্যাপারটিতে ওয়ার্নিং সিস্টেম আবশ্যক করে দিচ্ছে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ব্রিটিশ বোর্ড অফ ফিল্ম ক্লাসিফিকেশন (বিবিএফসি) গেমসের ক্ষেত্রে বৈধ বয়স ঠিক করছে যাতে সেক্স, ভায়োলেন্স অথবা ফিল্ম ক্লিপস অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ফিল্মের মতই গেমস রেটিং করা হবে। যেখানে ‘ইউ’ হচ্ছে আন ক্লাসিফায়েড বা চার বছরের উপরে যে কারো জন্য গ্রহণযোগ্য, পিজি (প্যারেন্টাল গাইডেন্স) এবং ১২, ১৫ ও ১৮। এই রেটিং রঙিন ত্রিভূজ বা বৃত্তের মত বক্স অফিসে ডিসপ্লে হবে। বাকীগুলো ভয়েন্টারি ইন্ডাস্ট্রি কোডের মাধ্যমে গাইড করা হবে যাকে বলে প্যান ইউরোপিয়ান গেম ইনফারমেশন (পিইজিআই) রেটিং। এখানে প্লেয়ারদের সর্বনিম্ন বয়স লক্ষ্য করা হবে। ব্রিটিশ মন্ত্রী চারটি রেগুলেশনের কথা প্রস্তাব করেছেন-

০ ‘বিবিএফসি’ সমস্ত গেমসকে রেটিং করবে।
০ ‘পিইজিআই’ রেট করবে কিন্তু নতুন বৈধ ব্যাকিং থাকবে।
০ ‘হাইব্রিড সিস্টেম’ যেখানে বিবিএফসি ১২ বছরের উপরের বাচ্চাদের গেম রেটিং করবে।
০ একটি নতুন কোড রিটেইলার এবং সাপ্লাইয়ারদের জন্য।



ব্রিটেন বিবিএফসি এর মাধ্যমে তারা একক সিস্টেম সাপোর্ট করে। তবে গেম ইন্ডাস্ট্রি জানিয়েছে, বিবিএফসি সিস্টেম বাচ্চাদের জন্য অতিরিক্ত কোন নিরাপত্তা প্রদান করবে না এবং ফিল্মস এবং গেমসের মধ্যে কনফিউশন তৈরি করবে। দ্য এন্টারটেইনমেন্ট এন্ড লেজার সফটওয়্যার পাবলিশারস এসোসিয়েশন (ইএলএসপিএ) অবশ্য ‘পিইজিআই’ এর পক্ষে। তাদের মতে ৯৬ শতাংশ গেম ‘পিইজিআই’ রেটিং সিস্টেম রেট করতে পারে পক্ষান্তরে ‘বিবিএফসি’ মাত্র চার শতাংশ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, গেমস হচ্ছে বিনোদনের জন্য, কোন সহিংসতার উৎস নয়। তাই কিশোর অপরাধ যেন এর কারণে বেড়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখাই সংশ্লিষ্ট দেশ এবং ভিডিও গেম তৈরিকারক কোম্পানির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ খারাপ জিনিসগুলো গেমসের মাধ্যমে বাচ্চাদের ভেতরে ঢুকে তাদের খারাপ মানুষ হবার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে।