দ্রুত পরিবর্তনশীল তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে সমন্বিত কাজ করার বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রযুক্তি শিল্পে অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও দ্রুত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের সর্বত্র প্রযুক্তি সেবা প্রদান করা সম্ভব এবং এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিশ্চিত করতে কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরী কমিশন (বিটিআরসি)। গত ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম এর সদ্যদের সাথে বিটিআরসি কার্যালয়ে মতবিনিময়ের সময় বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব:) মঞ্জুরুল আলম উপরোল্লেখিত মন্তব্য করেন। ইন্টারনেট ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার গুরুত্ব যথাযথভাবে বাংলাদেশের মূল্যায়ন করার উপর গুরুত্ব প্রদান করে তিনি জানান, ‘ইন্টারনেটকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে না পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির পদক্ষেপ যথাযথভাবে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে না। এরই ধারাবাহিকতায় স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট প্রযুক্তি সকলের নিকট পৌছে দিতে বিটিআরসি ইতোমধ্যে ব্যান্ডউইডথ চার্জ তিন দফা কমিয়েছে। ফলে আইএসপিদের পক্ষে স্বল্পমূল্যে ব্যবহারকারী পর্যায়ে ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। আমরা মনেকরি, আমরা যদি ব্রডব্যান্ডের মূল্য কমাতে না পারি বা ইন্টারনেটকে দেশের সর্বত্র পৌঁছে না দিতে পারি তবে সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল ডিভাইড দূরীকরণ সম্ভবপর হবে না। বিটিআরসি স্বচ্ছ নীতিমালার আলোকে বিগত সময়ে নিজেদের কর্মকান্ড পরিচালনা করার মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্বের সর্বাধুনিক সকল প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়নের পথে নিজেদের পরিচালনা করতে সক্ষম হয়ে চলেছে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।’
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলা বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (বিআইজেএফ)-এর সদস্যদের সাথে মতবিনিময়কালে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যত রূপরেখা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। বিআইজেএফ-এর সভাপতি মোহাম্মদ কাওছার উদ্দিন মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ কমানোর পরিকল্পনা বিটিআরসি’র রয়েছে কিনা প্রশ্ন করেন। জবাবে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের সবসময়ই কর্মকান্ড পরিচালিত হয় বাংলাদেশে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি স্বল্পমূল্যে প্রদানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে। বর্তমানে সারাবিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম খরচে মোবাইলে কথা বলা সম্ভব। বিটিআরসি’র সময়োপযোগী কর্মকান্ড গ্রহণের ফলশ্রুতিতেই এই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। ইতোপূর্বে মোবাইলে কথা বলা বাংলাদেশে অনেক ব্যয়বহুল হলেও বর্তমানে প্রতি মিনিট মাত্র ৮৮ পয়সায় সম্ভব। বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে কম খরচে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ প্রদানের পাশাপাশি আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ কমিয়ে নিয়ে আসার।’ বিআইজেএফ-এর সাধারণ সম্পাদক মোজাহেদুল ইসলাম কর্তৃক বাংলাদেশের সিমিইউ৪ সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে দু’টি বিকল্প সাবমেরিন ক্যাবলের প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান জানান, ‘বাংলাদেশে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই বর্তমান চালু সাবমেরিন ক্যাবলের পাশাপাশি বিকল্প সাবমেরিন ক্যাবল বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বিটিআরসি। যদিও বেসরকারি পর্যায়ে সাবমেরিন ক্যাবলের সংখ্যা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট হয়নি এবং এই লক্ষ্যে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সাবমেরিন ক্যাবল সিস্টেমস্ লাইসেন্সিং গাইডলাইন সম্পর্কে মতবিনিময় করা হয়েছে। দেশের প্রয়োজনকে সর্বাগ্রে বিবেচনার মাধ্যমে বিটিআরসি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বেসরকারি উদ্যোগে সাবমেরিন ক্যাবলের সংখ্যা ১/২ হবে। সেই সাথে আমরা চেষ্টা করছি, সাবমেরিন ক্যাবলের ল্যান্ডিং সেন্টার কক্সবাজারের পরিবর্তে অন্যকোন স্থানে স্থাপন করার। কেননা, আমরা চাই না প্রাকৃতিক অথবা অনাকাঙ্খিত কোন ঘটনায় বাংলাদেশের জন্য অতীব গুরুত্বময় সাবমেরিন ক্যাবল সমূহ একসাথে যেন সংযোগ বিচ্যুত না হয়। একই সাথে আমরা নতুন সাবমেরিন ক্যাবল কোন পথের সাথে সংযুক্ত করব সেই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে প্রায় ৬০৫টি লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে বাংলাদেশে সর্বাধুনিক সকল প্রযুক্তি সেবা নিশ্চিত করতে। একই সাথে বিটিআরসি তাদের স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে বিগত সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে ৮৮১ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে। কলসেন্টার শিল্পের অগ্রগতি সম্বন্ধে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, ‘প্রায় ৩৫০টি প্রতিষ্ঠান কলসেন্টার স্থাপনের লাইসেন্স গ্রহণ করলেও এখনো তাদের কর্মকান্ড তেমনভাবে দৃশ্যমান নয়। আমরা চাই সুষ্ঠভাবে বাংলাদেশে কলসেন্টার শিল্পের বিকাশ লাভের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের পথকে সুগম করতে। আমি আশাকরি, আমাদের দেশের মেধাবী তরুণরা অচিরেই বাংলাদেশে কলসেন্টার শিল্পকে সাফল্যজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে এবং প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। আমাদের ১০ বছর পূর্বেই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সাধনের মাধ্যমে কলসেন্টার শিল্পে প্রবেশ করা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে কলসেন্টার শিল্পে কর্মরত ব্যক্তিদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি পাবার পরিপ্রেক্ষিতে এখনো বাংলাদেশের কলসেন্টার শিল্পে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ রয়েছে। তবে কলসেন্টার শিল্পকে কেন্দ্র করে প্রশিক্ষণের নামে কোনরূপ অনিয়মের বিষয়টি বিটিআরসি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে আসছে। ফলে কলসেন্টার শিল্পে অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হবে।’
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার এবং আইটি ম্যাগাজিনে কর্মরত আইসিটি সাংবাদিকদের ভূমিকা রয়েছে এবং ভবিষ্যতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রযুক্তির বিকাশ সাধনে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবঃ) মঞ্জুরুল আলম। উল্লেখ্য, বিগত সময়ে সুস্পষ্ট নীতিমালার আওতায় লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগখাতকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার মাধ্যমে বছরে ১৫০০ থেকে ২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেই সাথে অবৈধ ভিওআইপি কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাত তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগখাতকে বেসরকারি পর্যায়ে সুস্পষ্ট নীতিমালার আওতায় ছেড়ে দেবার লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গতবছর রেভিনিউ শেয়ারিং পদ্ধতির আওতায় তিনটি ক্যাটাগরিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহকে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) লাইসেন্স, ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) লাইসেন্স, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) লাইসেন্স প্রদান করে। আইজিডব্লিউ প্রযুক্তি চালু হওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগে বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ফলে গত বছর বহিঃর্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে আইসিটি শিল্পে যুগান্তকারী অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিটিআরসি’র সামগ্রিক কর্মকান্ড সম্বন্ধে সাংবাদিকদের ধারণা প্রদানের লক্ষ্যে আয়োজিত এই মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামের সদস্যবৃন্দ এবং বিটিআরসি’র কমিশনার মুনির আহমেদ, আলিবর্দী খন্দকার, মাহাবুবুর রহমান, ডিরেক্টর জেনারেল কর্ণেল মোঃ সাইফুল ইসলাম, পরিচালক সৈয়দ আহমেদ, রেজাউল কাদের, লে. কর্নেল শহিদুল আলম, সিনিয়র কনসালটেন্ট আব্দুল্লাহ এ ফেরদৌস, কমিশন সেক্রেটারি মাহবুব আহমেদ এবং মিডিয়া কনসালটেন্ট আব্বাস ফারুক উপস্থিত ছিলেন।
সৌজন্যে : দৈনিক ইত্তেফাক



