উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় থ্রিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের সর্বত্র মোবাইলে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবহারের লক্ষ্যে অচিরেই থ্রিজি লাইসেন্স প্রদান করবে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি). তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত থ্রিজি প্রযুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তেই মোবাইল ব্যবহারকারীরা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করতে সম্ভব হবে এবং এর মাধ্যমে জীবনমান ও আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় থ্রিজি প্রযুক্তির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্রুত লাইসেন্স প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে বিশ্বব্যাপী মোবাইল ফোন শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন জিএসএমএ। গত ১২ নভেম্বর জিএসএম এসোসিয়েশনের উদ্যোগে স্থানীয় একটি হোটেলে থ্রিজি প্রযুক্তি সম্পর্কিত সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে জানানো হয় এই লাইসেন্স ইস্যু করা হলে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকদের জন্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য হবে। ২১০০ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সীতে এই লাইসেন্স দেয়া হলে তা বাংলাদেশী মোবাইল ফোন অপারেটরদের দ্রুত মোবাইল ব্রডব্যান্ড সেবা (এইচএসপিএ) নিশ্চিত করা সহজ হবে। এর ফলে গ্রাহকরা উচ্চগতির ইন্টারনেট ও অন্যান্য অনলাইন সার্ভিস ব্যবহারের সুযোগ পাবে। উল্লেখ্য, মোবাইলের ক্রমউন্নতিতে মানুষের জীবন মান উন্নয়নে নতুন এই থ্রিজি প্রযুক্তি মূলত ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) এর স্ট্যান্ডার্ড। থ্রিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইল ফোন অপারেটররা আরো দ্রুত গতিতে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে অনেক বেশি উন্নততর সেবা প্রদান করতে পারবে। ভয়েস টেলিফোনি, ভিডিও কল, ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস ডাটা প্রভৃতি সুবিধা দিতে সক্ষম এই থ্রিজি প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে এইচএসপিএ ডাটা স্থানান্তরের রেট ১৪.৪ এমবিপিএস ডাউনলিংক আর আপলিংক ৫.৮ এমবিপিএস। আইইইই ৮০২.১১ স্ট্যান্ডার্ড যেমন ওয়াই-ফাই বা ওয়্যারলেস ল্যান নেটওয়ার্কের মতো এটি নয়। থ্রিজি নেটওয়ার্ক হলো ওয়াইড এরিয়া সেলুলর টেলিফোন নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে দ্রুত গতির ইন্টারনেট ও ভিডিও টেলিফোনি সম্ভব।
২০০১ সালে জাপানের এনটিটি ডকোমো প্রথম থ্রিজি’র সফল পরীক্ষা চালায়। বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি থ্রিজি মোবাইল সেবা চালু করে একই বছরে অক্টোবর মাসে। ২য় বাণিজ্যিক থ্রিজি চালু করে দক্ষিণ কোরিয়ার এসকে টেলিকম ২০০২ সালে সিডিএমএ প্রযুক্তির মাধ্যমে। ইউরোপে প্রথম থ্রিজি নেটওয়ার্ক চালু করে ব্রিটিশ টেলিকম ২০০১ সালে আর আমেরিকায় ভেরিজোন প্রথম ২০০৩ সালে চালু করে থ্রিজি নেটওয়ার্ক। অস্ট্রেলিয়ার এডিলেডে এম ডট নেট কর্পোরেশন ২০০২ সালে ফেব্রুয়ারিতে এই এমটিএস চালু করে এবং তা আইটি ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে প্রদর্শন করে। বাণিজ্যিকভাবে প্রথম হাচিশন টেলিকমিউনিকেশন ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় থ্রিজি নেটওয়ার্ক তৈরি করে যার নাম ‘নেক্সট জি’. অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঞ্জুরুল আলম (অবঃ). স্বাগত বক্তব্য রাখেন জিএসএম এসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (পাবলিক পলিসি) রিকার্ডের টাভার্স। এছাড়া বক্তব্য রাখেন গ্রামীণফোনের নতুন সিইও ওডভার হেশজেডাল এবং গিলবার্ড টবিন এর কনসালটেন্ট রব নিকোলস। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিটিআরসি সবসময় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি বাংলাদেশে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। সর্বাধুনিক থ্রিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকরা দ্রুতগতির মোবাইল ফোন ইন্টারনেট পরিসেবা পেতে সক্ষম হবে। থ্রিজি প্রযুক্তি বাংলাদেশে বাস্তবায়নের জন্য লাইসেন্স প্রদানের লক্ষ্যে বিটিআরসি কাজ করে চলেছে এবং আশা করা যাচ্ছে আগামী বছরের প্রথমার্ধে থ্রিজি লাইসেন্স প্রদান করা সম্ভব হবে। শহরাঞ্চলের ন্যায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থ্রিজি প্রযুক্তির বিকাশ সাধন করা সম্ভব হলে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা মোবাইলফোন ব্যবহারকারীদের নিকট প্রদান করা যাবে।’ জিএসএমএ-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (পাবলিক পলিসি) রিকার্ডের টাভার্স বলেন, ‘বাংলাদেশে যেখানে অতি অল্পসংখ্যক ফিক্সড ফোনের সংযোগ রয়েছে, সেখানে মোবাইল ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তির বিস্তার ঘটালে ব্যাপক হারে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। পৃথিবীর মধ্যে মোবাইল ফোনের দ্রুত সম্প্রসারণশীল বাজারগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অথচ এখানে তথ্য ও যোগাযোগ সার্ভিসের ব্যাপক সুপ্ত চাহিদা রয়েছে। এ সার্ভিস চালু হলে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা অর্থবহ হয়ে উঠবে, আরো বেশি গতিশীলতার সৃষ্টি হবে ব্যবসা-বাণিজ্যে।’
ওয়ার্কিং সেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ মাহবুবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশে থ্রিজি প্রযুক্তির বাস্তবায়ন সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, ‘আমরা বিশ্বের সাথে প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে চলার লক্ষ্যে বাংলাদেশে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমূহ বাস্তবায়নে আগ্রহী। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে থ্রিজি অচিরেই গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনেট পরিসেবা বৃহৎ পরিসরে প্রদান করতে সক্ষম হবে বলে আমি আশা করি।’
দেশের ইন্টারনেট শিল্পে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম এই থ্রিজি প্রযুক্তির লাইসেন্স প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে বিটিআরসি। আগামী মার্চ/এপ্রিল নাগাদ থ্রিজি লাইসেন্স প্রদানের সম্ভাবনা রয়েছে। থ্রিজি প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়ন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ওডভার হেশজেডালপ্রধান
নির্বাহী কর্মকর্তা, গ্রামীণফোন
থ্রিজি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক কার্যক্রম বিস্তারের সুযোগ রয়েছে। মোবাইল ব্রডব্যান্ড ব্যবহারের মাধ্যমে ফিক্সড ব্রডব্যান্ডের তুলনায় বিস্তৃত অঞ্চলে অধিক সংখ্যক ব্যবহারকারীদের নিকট দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের সর্বস্তরে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পাবলিক ইনফরমেশন সমূহে দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে যতদ্রুত সম্ভব থ্রিজি প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত এবং এক্ষেত্রে যোগ্যতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ করে চলেছে। নতুন প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হলে অচিরেই বাংলাদেশে থ্রিজি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।