বাংলাদেশ ক্ষুদ্র একটি দেশ, আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি, ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এ দেশ। জ্বলে পুড়ে ছারখার তবুও মাথা নোয়াবার নয়- এটাই বাঙালির বৈশিষ্ট্য, রয়েছে রক্তে মিশে। তাই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এ জয় রথে প্রবাসীদের অবদান অকল্পনীয়-এ যেন অন্ধের যষ্ঠি। এই কীর্তিমানদের কীর্তিতে বিশ্ব পরিমন্ডলে পরিচিত একটি দেশ বাংলাদেশ। প্রবাসী কীর্তিমানদের তালিকায় যুক্ত হলো আরেক নক্ষত্রের যার নাম হলো ফয়সাল হক। যার কর্মকান্ডে আইটি বিশ্বে বাংলাদেশ এখন সুপরিচিত একটি দেশ। আইটি বিশ্বের প্রথম ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে প্রবাসী বাঙালি ফয়সাল হক রয়েছেন। বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানসহ নামিদামিদের ডিঙিয়ে ‘প্রভাবশালী’ হিসেবে স্থান করে নেন আমাদের গৌরব ফয়সাল হক।
আইটি বিশ্বের ‘প্রভাবশালী’র কাতারে আসার গুণাবলী
আইটি’র প্রভাবশালীদের তালিকা করা হয়েছে তাদের নিয়ে যারা দীর্ঘদিন যাবত আইটি বিশ্বে কাজ করছেন, প্রশংসিতও হচ্ছেন। তাদের নিয়েই তালিকা করা হয়েছে যাদের আইটি বিশ্বে প্রভাব ফেলার মতো সকল যোগ্যতা রয়েছে, আইটির পরিবর্তনে সক্ষম ও আইটির বা টেকনোলজির ইনোভেশনে বা নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটাতে সক্ষমতা এবং এই সেক্টরের ম্যানেজমেন্টে গভীর প্রজ্ঞা রয়েছে তাদেরই মূলত এ তালিকায় আনা হয়েছে। ‘প্রভাবশালী’ এসব ব্যক্তিদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত কর্মপন্থার উপর গুরুত্ব দিয়েই তালিকা নিরূপণ করা হয়। ফলসাল হকের মধ্যে সকল গুণাবলী বিদ্যমান বলেই তাকে এ গুরুত্বপূর্ণ তালিকায় স্থান দেয়া হয়।
কারা আছেন এ তালিকায়
ফয়সাল হক এ তালিকায় বা র্যাংকিং এ ৫৫ তম স্থানে রয়েছে। তার সাথে যারা রয়েছে তাদের কয়েকজন হলেন ওরাকলের লেরি এলিসন, অ্যাপেলের স্টিভ জবস, মাইক্রোসফটের স্টীভ বলমার, আইবিএম-এর স্যাম পালমিসিয়ানো, এইচপি’র মার্ক হার্ড, গুগলের ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিন, প্রতিটি শিশুকে এক ল্যাপটপ প্রকল্পের জনক নিকোলাস নেগ্রোপনট্,ে উইকিয়ার জিমি ওয়েলস, ভেনচার ক্যাপিটালিস্ট জন ভোয়ের, লেখক গ্যারি হেমেল, প্রফেসর টম ডেভেনপোর্ট, জামার্ন চ্যান্সেলের এঞ্জেলা মার্কেল প্রমুখ।
ফয়সাল হকের কর্মকান্ড
ফসসাল হক ১৯৯৯ সালে চালু করেন বিটিএম বা বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন, তিনিই বিটিএম’র প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান ও সিইও। ২০০৩ সালে তিনি বিটিএম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন যা একটি অলাভজনক গ্লোবাল থিংক ট্যাংক বা পরিকল্পনা পর্ষদ। আইটি বিশ্বের ফয়সাল হক ‘মিঃ কনভারজেন্স’ হিসেবে খ্যাত। ফয়সাল হকের বিটিএম’র প্রধান লক্ষ্য হলো ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স এর এপ্লিকেশন, যেখানে তিনি সাসটেইনেবল বিজনেসের সাথে টেকনোলজির সমন্বয় করিয়েছেন যেন বিজনেস টেকনোলজির দ্বারা ডেলিভার করা যায়। ফয়সাল হক হলেন জেনারেল ইলেকট্রিক বা জিই এর একজন প্রাক্তন এক্সিকিউটিভ এবং পাশাপাশি অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিতেও কাজ করেছেন। হক আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত, ভিশনারি উদ্যোক্তা ও পুরস্কারপ্রাপ্ত থট্ লিডার বা টেকনোচিন্তাবিদ। ফয়সাল হক টেকনোলজি ও বিজনেসের সমন্বয়ের পাশাপাশি সোস্যাল ও ইকোনমিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টিও আমলে নিয়ে কাজ করছেন ফলে তার অর্গানাইজেশন ‘হোল ব্রেইড্ এন্টারপ্রাইজ’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।
মি. হক ব্যক্তিগতভাবে ও কর্মকান্ডে সোস্যাল, ইকোনমি ও জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সমূহের গ্লোবাল সচেতনতার ব্যাপারে আগ্রহী এবং ইকোনমিক প্রবৃদ্ধি ও শিক্ষার জন্য কাজ করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ এ বিটিএম ইনস্টিটিউট চালু করেন। যার মাধ্যমে বিজনেস ও টেকনোলজির মধ্যকার ব্যবধান দূর করার জন্য ব্রীজ তৈরির মাধ্যমে একাডেমিক, সোস্যাল, ইকোনমিক, কালচারাল এফোর্ট ও চিন্তাসমূহ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন।
ফয়সাল হক ১৯ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি অফ মিননেসোটাতে পড়ার সময় প্রথম বাণিজ্যিক বিজনেস টেকনোলজি প্রোডাক্ট তৈরি করেন। তিনি বিটিএম প্রতিষ্ঠার আগে আরও দু’টি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। রিইউকেব্যাল বা পুনরায় ব্যবহার্য সফটওয়্যার এপ্লিকেশন কম্পোনেন্টের একজন অগ্রপথিকও তিনি। কমজীবনে একজন ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৯৫ সালে জিই’তে কাজ করার সময় একজন নতুন ও তরুণ টেকনোলজি এক্সিকিউটিভ হিসেবে ‘বি টু বি ইলেকট্রনিক স্পিন অফ’ বাজারে আনেন।
মিশুক প্রকৃতির ফয়সাল হক একজন ভালো লেখকও, তার ব্যস্ততার পাশাপাশি টেকনোলজি নিয়ে লেখালেখিও করে থাকেন। তার কয়েকটি বই রয়েছে যার জন্য তিনি একাধারে পুরস্কৃত ও সম্মাননা পেয়েছেন- এগুলোর মধ্যে এলাইনমেন্ট ইফেক্ট, উইনং ফি থ্রি লেগড্ রেস, সিক্স বিলিয়ন মাইন্ডস ও সাসটেইন্ড্ ইনোভেশন অন্যতম। তার দুটি বই সাসটেইনড ইনোভেশন ও উইনিং দি থ্রী লেগড রেস গত কয়েক বছরের ‘ট্রান্সফরমেশন বইয়ের’ তালিকায় শীর্ষ ৫ এ ছিল। সাসটেইনড ইনোভেশন সিআইও ইনসাইট ম্যাগাজিনের ২০০৭ সালের প্রথম দশটি বিজনেস বইয়ের একটি। তাছাড়া তিনি অনেক আর্টকেল লিখেছেন, যা প্রকাশিত হয়েছে বিজনেস উইক, দি ইকোনমিস্ট ফোর্বস্, দি ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল ও সিআইও ম্যাগাজিনসমূহে।
ফয়সাল হকের বিটিআই ও এর কার্যক্রম
বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন বা বিটিএম তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯৯ সালে। বিটিএম হলো ম্যানেজমেন্ট সলিউশন প্রোভাইডার বা ব্যবস্থাপনার সমাধান প্রদানকারী, বিটিএম নতুন বিজনেস মডেল তৈরি করে, অর্থায়ন কার্যধারার বৃদ্ধি করে, বিভিন্ন গ্লোবাল কর্পোরেশনের অপারেশনাল ইফিসিয়েন্সি বাড়াতে সহায়তা করে, সরকারি এজেন্সিসহ বিভিন্ন সোস্যাল বিজনেস কোম্পানিকে বিটিএম এর ইউনিক প্রোডাক্ট ও বুদ্ধি বৃত্তিক মেধার মাধ্যমে পরিচালনার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দেয়। ফয়সাল হকের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ‘ইউনিক বিজনেস মডেল’ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে বিজনেস ও টেকনোলজি একত্রে ব্যবস্থাপনার জায়গায় এনে বিশ্বের বিভিন্ন লিডিং কর্পোরেট, সরকার ও সোস্যাল বিজনেস ফার্মদের সহায়তা করেছে। বিটিএম ম্যানেজমেন্ট প্রসেস, সফটওয়্যার এপ্লিকেশন, ক্রস ডিসিপ্লিনারি ডোমেইন অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে টেকনোলজির স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহক বা ক্রেতাদের সাথে মার্কেটার বা ব্যবসার সম্পর্ক সুদূঢ় করতে বদ্ধপরিকর। এদের ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ টিম শুধু বিটিএম-এর বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা পরিবর্ধনেই কাজ করছে না তার সাথে প্রোডাক্ট বুদ্ধিবৃত্তিক মেধা অর্জনেও কাজ করছে এবং বিশ্ব জ্ঞান নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করছে যেন প্রতিযোগিতাময় সুবিধা পাওয়া যায়। বিটিএমের সাফল্যের ছোঁয়া সব সেক্টরেই লেগেছে। যেমন- ম্যানুফেকচারিং, কনজিউমার গুডস্ হসপিটালিটি, ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্স্যুরেন্স, ডিফেন্স, সরকারি এজেন্সী ও বিভিন্ন ইউটিলিটিসমূহ বিটিএমের গ্রাহক তালিকায় রয়েছে। ১৯৯৯ সালের তুলনায় রেভিন্যু ১০৫৭ শতাংশ বেশি ২০০৩ সালে, ২০০৪ সালে রেভিন্যু ১০৯৮ শতাংশ এবং র্যাংকিং এ ২০৭ হতে ১৬৭ তম স্থানে এসেছে।
বিটিএম এর গ্রাহক ও সহযোগীর মধ্যে বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক কোম্পানি ও ব্র্যান্ড রয়েছে যেমন জেপি মরগান, মারিওট্ট, পাক্কার, পেপসি কো, নর্মরপ গ্রুপম্যান, সাবরি, ইউএস ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট, ডব্লিউসি ব্রাডলি, বেস্ট ওয়েটার্ন, আমেরিকার ফাইনান্সিয়াল গ্রুপ, বিএনপি পরিবাস, বিংকস, কম্পইউএসএ, এক্সিলন, ফ্রেঞ্চ সোস্যাল সিকিউরিটি সার্ভিস, আইবিএমএসহ বিভিন্ন একাডেমী। সোস্যাল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ হিসেবে বাংলাদেশী গ্রামীণ সলিউশনও বিটিএম’র গ্রাহক।
ফয়সাল হকের বিটিএম এগরিম এখন বিশ্বের ২০০০ কোম্পানিসহ বিভিন্ন দেশের সরকার এনজিও ও সোস্যাল উদ্যোক্তাদের সাথে কাজ করছে বিভিন্ন ‘সোস্যাল বিজনেস মডেল ইনোভেশনের’ মাধ্যমে যাতে করে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন সম্ভব হয়। প্রবাসী ফয়সাল হকের মঙ্গল ও সাফল্য গাঁথা অব্যাহত থাকুক এটাই কাম্য।