প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার। তথ্য মহাসাগরে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু বেশি দিনের নয়। উন্নতবিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধসমূহ অনেকদিন থেকে সংগঠিত হলেও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বিস্তৃতি ঘটে চলেছে সাইবার অপরাধ নামন্বিত অপরাধ সমূহ। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে প্রতিনিয়তই অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়ে চলেছে। প্রযুক্তিবিহীনতা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজের অবস্থানকে অনেক পিছনে ফেলে দেয়। প্রযুক্তির কল্যাণে দ্রুত এগিয়ে চলছে বিশ্ব। এরই ধারাবাহিকতায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রভূত উন্নতি সাধন করে চলেছে উন্নতবিশ্বসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহ। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ইন্টারনেট তথা সাইবার বিশ্বে ঘটে যাওয়া অপরাধ সমূহকেই মূলত ‘সাইবার অপরাধ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হ্যাকিং-এর ঘটনা ঘটেছে যা এই দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) ওয়েব সাইট (িি.িৎধন.মড়া.নফ) হ্যাক করে চার তরুণ। যদিও দ্রুততম সময়ে র্যাব কর্তৃক তাদের ওয়েব সাইট পুনরায় চালু করা হয় এবং জড়িত চার হ্যাকারকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হ্যাকারদের গ্রেফতার করা হলেও তাদের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, তারা দীর্ঘদিন থেকেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সাইট হ্যাক করে আসছিল কৌতুহল বশত। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন থেকেই দেশে সাইবার অপরাধের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন। কেননা বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে সাইবার অপরাধের প্রবণতাও। ই-মেইলের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে হুমকি, হ্যাকিং, পাসওয়ার্ড চুরি, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি সহ পাইরেসি এবং কোন ব্যক্তির বিশেষ করে মহিলা এবং শিশুদের ছবি অশ্লীল সাইটে হোস্ট করার ঘটনাও ঘটে চলেছে। এরই প্ররিপ্রেক্ষিতে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ।
সম্প্রতি র্যাবের ওয়েব সাইট হ্যাক করার মাধ্যমে বিষয়টি দেশবাসীর নিকট দৃশ্যমান হলেও হ্যাকিংয়ের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত তরুণদের দলনেতা জানায়, এ পর্যন্ত তারা দেশ-বিদেশের ১৮টি ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইট, সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ওয়েব সাইটসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বেসরকারি ওয়েব সাইট। তারা মূলত কৌতুহল বশত এবং আইন সম্পর্কে সচেতন না থাকায় পিএইচপি ও লিনাক্স অপারেটিং পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ওয়েব সাইট হ্যাক করে। র্যাবের ওয়েবসাইট হ্যাক করতে তারা প্রথমে হিমু নামক ভাইরাস আপলোড করে এবং বাইপাস করে ঐ সফটওয়্যারটির মাধ্যমে হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটায়। বিভিন্ন পত্রিকা ও ব্লগ থেকে হ্যাকিংয়ের তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে তারা তাদের জ্ঞানের বিস্তার ঘটায়। তাদের মতে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল এবং এই সব সাইটের ডোমেইন নেইম সিস্টেম (ডিএনএস) এবং ফাইল ট্রান্সফার প্রোটোকল (এফটিপি) খুবই দুর্বল। কেননা, এই সকল ওয়েব সাইট তৈরিতে সাধারণত পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের র্যাবের ওয়েবসাইট হ্যাক করতে সময় লাগে মাত্র ১১ ঘন্টা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে সাইবার অপরাধ একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। ওয়েব সাইট হ্যাকিংয়ের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করণের লক্ষ্যে প্রাথমিক তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, হ্যাকার কর্তৃক লিনাক্স নামে একটি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের লাইন হতে র্যাবের ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইন্টারনেটের আইপি নম্বর সংগ্রহ করে মিরপুর হতে গ্রেফতার করা হয় চারজন হ্যাকারকে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় হ্যাকিংয়ের কাজে ব্যবহৃত দুটি কম্পিউটার ও ৭২টি সিডি। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তিখাতে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের অনেকের সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে সচেতনতার অভাব দৃশ্যমান। কেননা, বাংলাদেশে বিদ্যমান তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে ২০০৬-এর ৫৪ ও ৫৫ ধারায় সাইবার অপরাধের শাস্তি ৩ থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ৩ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা অথবা উভয়দন্ড হতে পারে।
মূলত অন্যের ওয়েব সাইট বা নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে প্রবেশ করাকে হ্যাকিং হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এছাড়াও কম্পিউটারের সোর্স কোড ভাঙার মাধ্যমেও একজন ব্যক্তি সাইবার অপরাধের আওতায় দোষী প্রমাণিত হয়ে থাকে। সাইবার অপরাধ সমূহকে সাধারনত তিনভাগে ভাগ করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। ১. ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত সাইবার অপরাধ ২. সম্পত্তি বিষয়ক সাইবার অপরাধ ৩. দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংগঠিত সাইবার অপরাধ।
ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংগঠিত সাইবার অপরাধ
সাইবার অপরাধের ভয়াবহতা এবং বিস্তৃতি ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্বাধিক হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোন অপরিচিত ব্যক্তি আপনার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক তথ্যসমূহ ব্যবহার করে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করতে পারে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার গোপনীয় তথ্য হ্যাক করার মাধ্যমে আপনার ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে আপনার প্রভূত ক্ষতিসাধন করতে পারে। সেই সাথে আপনার ছবি এবং ঠিকানা অনাকাঙিক্ষতভাবে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ ওয়েবসাইটে প্রকাশের মাধ্যমে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে চরম ক্ষতির সম্মুখীন করে থাকে সাইবার অপরাধীরা। এছাড়াও ইন্টারনেটের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদেরকে সাইবার সেক্সের দিকে প্রলুব্ধ করা সাইবার অপরাধের অন্যতম খারাপ দিক। এছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে সাইবার অপরাধের মাধ্যমে আপনাকে প্রতারিত হতে পারে। বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট হতে ই-মেইল এর মাধ্যমে প্রতারণার সম্মুখীন হতে পারেন আপনি। প্রতারণার ধরনেও রয়েছে ভিন্নতা।
সম্পত্তি বিষয়ক সংগঠিত সাইবার ক্রাইম
ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংগঠিত সম্পত্তি বিষয়ক সাইবার ক্রাইম সমূহের ভয়াবহতা অনেক বেশি। আপনার প্রতিষ্ঠান অথবা সম্পত্তির তথ্য আপনার অগোচরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যের কাছে বিক্রি করে থাকে সাইবার অপরাধীরা। এক্ষেত্রে আপনার প্রতিষ্ঠানের অথবা সম্পত্তির সমস্ত তথ্য জেনে নিয়ে আপনার আগোচরে অন্যব্যক্তির সাথে বিক্রয়চুক্তি/ ব্যবসায়িক চুক্তির মাধ্যমে প্রতারিত করা হয়ে থাকে।
দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংগঠিত সাইবার ক্রাইম
ই-গভর্নেন্সের আওতায় প্রযুক্তির সুফল সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে প্রায় সকল দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহেরই ওয়েবসাইট রয়েছে। উদ্দেশ্য, ওয়েবের মাধ্যমে সরকারি কর্মকান্ডের সাথে জনগণকে সম্যক সেবা প্রদান করা। কিন্তু সাইবার অপরাধীরা সেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট সমূহ হ্যাক করে মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে এবং কুরুচিপূর্ণ ছবি সংযুক্ত করণের মাধ্যমে সেদেশের জনগণকে প্রতারিত করে থাকে এবং বহিঃবিশ্বের নিকট সে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে থাকে। বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের পরিকল্পনা আশাব্যঞ্জক বলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তনশীল তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সংঘটিত সাইবার অপরাধের ভিন্নতার কারণে প্রতিরোধের লক্ষ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কোন বিকল্প নেই।
ইন্টারনেট ভিত্তিক এই সাইবার অপরাধের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হিসেবে বিবেচিত হয় অপরাধীর যেকোন স্থান হতে অপরাধ করার স্বাধীনতার বিষয়টিকে। ফলে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অচীরেই বিষয়টির প্রতি যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়।