ভদ্রলোকের নাম ডেভিড জি থমসন। তিনি একটা বই লিখেছেন, ব্লু প্রিন্ট টু আ বিলিয়ন। পশ্চিমা বিশ্বে বইটির গায়ে ‘বেস্ট সেলার’ তকমা এঁটে গেছে। কোনো প্রতিষ্ঠান কীভাবে ‘বিলিয়ন ডলার’ কোম্পানি হয়ে ওঠে সেটাই এ বইয়ের বিষয়। তথ্য, তত্ত্ব আর উদাহরণে বইটি যথেষ্টই কৌতুহল তৈরি করে। ছোট বা মাঝারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয় সে ব্যাপারে লেখক স্বয়ং জানালেন আরও অনেক কিছু। বিলিয়ন ডলার কোম্পানি হতে কত দিন সময় লাগতে পারে? বেশ কিছু উদাহরণ টেনে স্যাপ সামিট ২০০৮-এ থমসন বললেন, ‘এটার ঠিক নেই। বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে সিসকো সিস্টেমসের লেগেছে সাত বছর, আবার গুগলের লেগেছে ১৮ মাস।’


তবে সময়ের হিসাব যা-ই হোক, কে কত দক্ষতার সঙ্গে সঠিক প্রযুক্তিকে তার প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজে লাগাতে পারছে, সেটাই বড় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে−এমন মত থমসনের। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে গতি বাড়াতে, লাভ বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বিত ব্যবহার এখন যে একেবারেই দরকারি সে মত দিয়েছেন তিনি। শুধু বিলিয়ন ডলার কোম্পানি নয়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের গ্রাফ খাড়া রাখতে এ যুগে প্রযুক্তির ধাਆাটা জরুরি। আর এটা তো আমাদের আশপাশে তাকালেও বোঝা যায়। বিশাল খাতায় হিসাব রাখা, কার্বনপেপারে রসিদ কাটা−এসবের বিপরীতে কম্পিউটারের ব্যবহার সময় বাঁচানোর পাশাপাশি লাভটাকেও বাড়িয়ে দেয় অনেকখানি। ব্যবসা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শুধু কম্পিউটার নিয়ে গেলেই তো হবে না, নিয়ে যেতে হবে সফটওয়্যার, যন্ত্রপাতিসহ তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বিত এক সমাধানসেবা। সমাধানদাতা হিসেবে বিশ্বে এখন এক নম্বর প্রতিষ্ঠান স্যাপ (এসএপি)। ৪ থেকে ৬ জুন ভারতের মুম্বাই শহরে স্যাপ ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের বার্ষিক সম্মেলনে এ প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি সেবা আর সমাধানের নতুন সব বিষয় সম্পর্কে জানা গেল। সম্মেলনে বাইরে থেকে যেমন এসেছিলেন ডেভিড জি থমসনের মতো ব্যক্তিত্ব, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক দুর এগিয়ে যাওয়া এমআরএফ, টিভিএস মোটরস, এশিয়ান পেইন্টের মতো বেশ কিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকেরাও উপস্িথত ছিলেন। তাঁরা বলেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা। গ্র্যান্ড হায়াত মুম্বাইয়ে সম্মেলনের পাশাপাশি প্রদর্শনীও চলেছে।


এগিয়ে চলার প্রযুক্তি
১৯৭২ সালে জার্মানিতে স্যাপের শুরু। মানে বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির গোড়ার দিককার প্রতিষ্ঠান এটা। এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে এর কার্যক্রম। এমনকি বাংলাদেশেও। যেহেতু ঘরোয়া কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য কোনো পণ্য বানায় না স্যাপ, তাই সাধারণ্যে এর পরিচিতি কম। তবে অসাধারণ্যে এটিই ব্যাপকভাবেই পরিচিত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্যাপের তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবা ব্যবহার করে। গত বছর এ প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আয় হয়েছে এক হাজার ২৫ কোটি ইউরো। মুম্বাইয়ের এ আয়োজনে বোঝা গেল, ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও গুরুত্ব দিচ্ছে স্যাপ। স্যাপ ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রঞ্জন দাস বললেন, ‘বড় বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান তো বটেই, স্যাপের সেবা বা সমাধান ব্যবহার করতে চায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানও (এসএমই); নিতে চায় স্যাপের প্রযুক্তি।’ এর ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি, ‘বড় প্রতিষ্ঠান চায় বাজারের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে থাকতে। আর ছোট বা মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমেই চায় তার সব কাজকর্মে স্বয়ংক্রিয় এক প্রযুক্তিব্যবস্থা (অটোমেশন)। এ জন্য স্যাপের পণ্যগুলো আদর্শ।’


স্যাপ শুধু নিজের মতো করে প্রযুক্তি সেবা দেয় না। আগেই বলা হয়েছে, যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা ইত্যাদির সমন্বয়েই স্যাপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযুক্তির সমাধান তৈরি করে দেয়। এর সঙ্গে স্যাপ প্রযুক্তির জন্য বিশেষ পেশাজীবীও তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রশিক্ষণের কাজটি আরও সহজ করতে এবং স্যাপ পেশাজীবীর সংখ্যা বাড়াতে শুধু ভারতেই ৫০টির বেশি ই-লার্নিং কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। ফলে প্রযুক্তি পেয়ে সেটিকে কাজে লাগানোও কোনো সমস্যা নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য স্যাপের অনেক পণ্য আছে। তবে এটা তো ঠিক, একটি মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের যে ধরনের কাজকর্ম, একটি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাজের ধারা তেমন নয়। তাই স্যাপের আছে আলাদা প্রযুক্তি সমাধান। এখন ২৭ ধরনের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য স্যাপের আলাদা সমাধান বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠান যে ঘরানারই হোক, সমাধান মিলবেই।


শুধু একা একা নয়সমন্বিত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে হয়, তাই স্যাপ একা নয়। সে প্রমাণ পাওয়া গেল প্রদর্শনীতে ঢুকে। স্যাপের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সমাধান করছে বিশ্বখ্যাত অসংখ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। আইবিএম, হিউলেট-প্যাকার্ড (এইচপি), ফুজিৎসু, সান মাইক্রোসিস্টেম সিমেন্সের মতো তথ্যপ্রযুক্তির নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান তো আছেই; তেমনি আছে উইপ্রো, সত্যম, মহিন্দ্র, রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্সের মতো ভারতীয় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। এ রকম অসংখ্য প্রতিষ্ঠান স্যাপের অংশীদার। প্রদর্শনীর পুরোটাই ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের নানা রকম সফটওয়্যার ও যন্ত্রপাতির পসরা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই সেইসব সেবা ও প্রযুক্তি দেখিয়েছে যেগুলো ব্যবসায় কাজে লাগে। নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট এমনকি মোবাইল ফোনভিত্তিক সেবা ছিল প্রদর্শনীতে। ছিল স্যাপের নতুন পণ্যগুলো ব্যবহারের হাতে-কলমে নির্দেশনা।এ সম্মেলনে জানানো হলো, স্যাপের এখন নতুন চার রকমের প্রযুক্তিপণ্য আছে। আড়াই হাজার কর্মী আছে এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য স্যাপ বিজনেস স্যুট, এর কম কর্মীর জন্য বিজনেস অল ইন ওয়ান, ১০০ থেকে ৫০০ কর্মীর জন্য বিজনেস বাই ডিজাইন আর ১০০-র কম কর্মী আছে এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য বিজনেস ওয়ান। স্যাপের পণ্য ও সেবা নিতে খরচ কেমন? কর্মকর্তারা জানালেন, এ তথ্য স্যাপের ওয়েবসাইটে (িি.িংধঢ়.পড়স) গেলেই জানা যাবে। কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান, কী কী কাজের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, কর্মী কয়জন ইত্যাদি তথ্য ওয়েবসাইটে লিখে দিলে প্রতিষ্ঠানটির জন্য প্রয়োজনীয় সমাধান ও তার খরচাপাতির হিসাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে স্যাপের প্রযুক্তি ব্যবহারের হার দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে স্যাপের মোট ৪৪ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৩৪ হাজারই ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের। অর্থাৎ ৬৮ শতাংশ এ গোত্রীয়।


বাংলাদেশ প্রসঙ্গস্যাপ ইন্ডিয়ার এ আয়োজনে বিভিন্ন গোলটেবিল বৈঠক, সংবাদ সম্মেলন ইত্যাদিতে বারবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে সংগত কারণেই। বাংলাদেশে এখন ১৫টির মতো প্রতিষ্ঠান স্যাপের প্রযুক্তি ব্যবহার করে−জানালেন স্যাপ ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা দেব ভট্টাচার্য। তিনি জানালেন, করপোরেট আর এসএমই দুই ঘরানার প্রতিষ্ঠানই স্যাপের গ্রাহক। বাংলাদেশে গ্রাহকসংখ্যা দ্রুত বাড়বে বলে জানা গেল। স্যাপের মতো প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে একটা বিষয় চলে আসেই। এত বড় প্রতিষ্ঠান বাজারে এলে দেশি সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কি দাঁড়াতে পারবে? তারা কি বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমান তালে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে পারবে? স্যাপ কর্মকর্তারা জানালেন, স্যাপ যেহেতু প্রযুক্তিগত সেবার স্থানীয়করণ (লোকালাইজেশন) করে দেয়, তাই একটা পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তিব্যবস্থা তৈরি করতে ছোট ছোট অনেক তথ্যপ্রযুক্তি সেবা বা সফটওয়্যার তৈরি করে নিতে হয়। এ কাজগুলো স্যাপ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই দেয়। ফলে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কাজের সুযোগ যেমন আছে তেমনি আছে অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগ। তাঁদের মতে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানও এ ক্ষেত্রে লাভবান হয়।