বিশ্বে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে চলছে জোর চিন্তাভাবনা আর ব্যাপক গবেষণা। প্রযুক্তির এই যুগে অপরাধীরা যেমন চালাক, আজকালকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোও তেমনি বুদ্ধিমান।আধুনিক প্রযুক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরিতে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের ছয় শিক্ষার্থী−তানভীর আল আমিন পপেল, মাহমুদুল ইসলাম রুমেল, সুকর্ণ বড়ুয়া, ইসতিয়াক জামান অয়ন, আশিক মাহতাব ও জিনাত ওয়ালি তাঁদের চতুর্থ বর্ষের ‘কম্পিউটার ইন্টারফেসিং’ কোর্সের প্রকল্প হিসেবে তৈরি করেছেন একটি তারহীন নজরদারি ব্যবস্থা। দেশীয় ও গবেষণামূলক প্রযুক্তি−এ দুইয়ের মিশেল ঘটিয়ে তৈরি হয়েছে এই তারহীন নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক। নজরদারির জন্য বিশেষ সারভেইলেন্স ক্যামেরার ব্যবহার সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই ক্যামেরা শুধু একদিকেই ভিডিও ধারণ করে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডানে-বাঁয়ে ঘুরে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে থাকে।এভাবে কোনো জায়গাকে সুরক্ষিত যেমন করা যায় না, তেমনি কোনো জায়গায় অনুপ্রবেশ ঘটলে ঠিক কোন জায়গায় হয়েছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বোঝারও কোনো উপায় নেই। তাই সুনিয়ন্ত্রিত, দক্ষ ও কার্যকর নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য এ প্রকল্পে তৈরি করা হয়েছে মাইক্রোকন্ট্রোলার-ভিত্তিক সেন্সর অংশ। সেন্সর অংশে আরও আছে ইনফ্রারেড এলইডি (লাইট ইমিটিং ডায়েড), ফটোট্রানজিস্টর আর বেতার যোগাযোগব্যবস্থা। অদৃশ্য ইনফ্রারেড রশ্মি দিয়ে কেউ অনুপ্রবেশ করেছে কি না, বোঝা যাবে। অনুপ্রবেশ ঘটলে সেন্সরের মাইক্রোকন্ট্রোলার তার ছাড়াই তথ্য পাঠাবে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। এ রকম অনেক সেন্সর থাকবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো ও লুকোনো, যার প্রতিটির দায়িত্ব একেকটি ছোট জায়গার ওপর জোর নজরদারি করা। সেন্সর অংশগুলোর অবস্থান এমন হবে, যেন ঘরের সবটুকুই নিরাপত্তার এর কঠিন জালে আটকা পড়ে।নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের সঙ্গে সেন্সরের যোগাযোগ যেহেতু তারবিহীন, তাই ঝਆিঝামেলা নেই। প্রতিটি সেন্সরের স্থানাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মাইক্রোকন্ট্রোলারে সংরক্ষিত থাকে, যা আগত বেতার সংকেত অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করে একটি সারভেইলেন্স ক্যামেরাকে। ক্যামেরাটি অনুভুমিক ও উল্লম্ব−দুই ভাবেই ঘোরে, যাতে সংশ্লিষ্ট সেন্সরকে ফোকাসে আনতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। একসঙ্গে একাধিক সেন্সর আক্রান্ত হলে ক্যামেরাও এদের প্রত্যেককে একটু একটু সময় করে ভিডিও করবে আর সেই ভিডিও সম্প্রচার করা হবে অন্য একটি কম্পিউটারে, তার ছাড়াই। সেন্সরের অবস্থান সহজে জানানোর জন্য ও ভিডিও দেখতে কম্পিউটারে একটি সফটওয়্যার লেখা হয়েছে। সেই সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের সঙ্গে বেতার মাধ্যমে যোগাযোগ করবে। সফটওয়্যায়ের পাঠানো নির্দেশ অনুযায়ী ক্যামেরাকে ইচ্ছামতো ঘুরিয়ে প্রতিটি সেন্সরের অবস্থান শিখিয়ে দেওয়া যাবে। এভাবে সেন্সর, নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র, কম্পিউটার থেকে নিয়ন্ত্রণ ইউনিট−সব মিলে তৈরি করে একটা তারহীন সেন্সর নেটওয়ার্ক। ইচ্ছামতো ব্যান্ডে বেতার কম্পাঙ্ক ব্যবহারে যেহেতু আইনগত বাধা আছে, তাই ৪৩৪ মেগাহার্টজ ফ্রি আইএসএম ব্যান্ডকেই ব্যবহার করা হয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আছে ‘বিকন ইউনিট’, যার কাজ সম্প্রচারের জন্য প্রতিটি ইউনিটের রেডিওকে সময় ভাগ করে দেওয়া।এই প্রকল্প জেলখানা, হাসপাতাল, ব্যাংক ভল্ট, হোটেল−এসব জায়গার নিরাপত্তা ও নজরদারির কাজে ব্যবহার করা যায়। এমনকি একে যেকোনো ঘরের দরজা, জানালা ইত্যাদির সঙ্গেও ব্যবহার করা যাবে। শিক্ষার্থীরা জানান, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি করা হলে, সেন্সরের খরচ অনেক কম, তাই বেশি সুরক্ষার জন্য সেন্সরের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যাবে। কোথাও একটি সেন্সর নষ্ট হলে সেটি সম্পুর্ণ সিস্টেমের ওপর আলাদা কোনো প্রভাব ফেলবে না। আর প্রতিটি সেন্সরই যেহেতু হিসাব-নিকাশের ক্ষমতাসম্পন্ন খুব ছোট কম্পিউটার (মাইক্রোকন্ট্রোলার), তাই সেন্সরের প্রোগ্রাম হালনাগাদ করেই নিরাপত্তাব্যবস্থায় আরও নতুন সুবিধা যোগ করা সম্ভব।পপেল-সুকর্ণরা জানান, ক্লাস শুরুর পর তাঁদের ইচ্ছা ছিল এমন একটি ধারণা বের করা, যা দেশ ও বিশ্বের বর্তমান পরিস্িথতির সঙ্গে যেমন মানানসই, তেমনি আগে কখনো তৈরি হয়নি। তাঁরা জানান, এ প্রকল্পে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দুটি। একটি হলো−ক্যামেরাটিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং অন্যটি বেতার চ্যানেল শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে সেন্সরগুলোর সঠিক সম্প্রচার নিশ্চিত করা।ক্যামেরাটি স্থাপন করার জন্য তাঁরা প্লাস্টিক উড ব্যবহার করে একটি ভিত্তি তৈরি করেন। সেটিতে বসানো হয় দুটি স্টেপার মোটর। আনুভুমিক স্টেপার মোটরের সঙ্গে ক্যামেরা লাগানোর জন্য গিয়ার ব্যবহার করতে হয়েছে। অন্যদিকে উল্লম্ব স্টেপার মোটরের সঙ্গে লাগাতে হয়েছে রেইল। সেই রেইলের কাটা খাঁজের সঙ্গে মিলিয়ে গিয়ার লাগানোর পর বাকি থাকে এতে প্রয়োজনমতো অটো ক্যালিব্রেশনের সুবিধা যোগ করা। বিভিন্ন সেন্সর ইউনিটের অবস্থানের সঙ্গে ক্যামেরার অবস্থানের সম্পর্ক স্বয়ংক্রিয় করার জন্য দরকার ক্যামেরার একটি অবস্থান, যাকে শুন্য অবস্থান হিসেবে ধরা হবে। নির্মাতারা এই ক্যালিব্রেশনের জন্য ইনফ্রারেড রশ্মি ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান।তবে প্রকল্প তৈরির সময় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাঁদের রেডিও নিয়ে। আমাদের দেশে ভয়েস রেডিও সহজলভ্য হলেও ডিজিটাল তথ্যের জন্য এগুলো ব্যবহার করতে হলে ব্যান্ডউইডথ কম থাকায় বাড়তি শব্দ (নয়েজ) পাওয়া যায় খুব বেশি। হাতে রেডিও তৈরি করতে গেলেও একই সমস্যা। কারণ, প্রয়োজনমতো ব্যান্ডউইডথ দিয়ে সঠিক শক্তিতে সম্প্রচার করতে যে অসিলেটর, কয়েল, মডুলেশন সার্কিট দরকার, তা বানানোর যন্ত্রপাতিও দেশের বাজারে পাওয়া যায় না। আর ডিজিটাল তথ্য পাঠানোর জন্য চিপও দেশে পাওয়া যায় না। বিকল্প হিসেবে বাজার থেকে খেলনা তারহীন গাড়ি কিনে এনে তাঁরা প্রথমে এর রেডিও পরীক্ষা করেন।কিন্তু সম্প্রচার গতি এত কম যে তা দিয়ে সেন্সরের কাজ করা সম্ভব নয়। সব শেষে ইন্টারনেট থেকে রেডিও চিপ কিনতে হয়।নির্মাতারা জানান, তাঁদের প্রাথমিক আইডিয়ায় ক্যামেরাটি ঠিকমতো সামনে-পেছনে, ওপরে-নিচে নিয়ন্ত্রণ করানোই ছিল প্রধান কাজ। কিন্তু শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা ও নিজেদের আগ্রহের কারণে তাঁরা এটি আরও উন্নত করেন এবং সম্পুর্ণ প্রকল্প তারহীন সেন্সর নেটওয়ার্ক হিসেবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এ প্রকল্পের তত্ত্বাবধয়ক আহমেদ খুরশিদ, কোর্স শিক্ষক আব্দুল্লাহ আদনান ও অনুপম দাস জানান, একই সঙ্গে যান্ত্রিক নড়াচড়া ও ভিডিও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে পুরো ব্যবস্থা সেন্সর নেটওয়ার্ক হিসেবে বাস্তবায়ন করা আগে কখনো সম্ভব হয়নি, তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবে ছোট-বড় অনেক সমস্যা থেকে যায়, স্বল্প সময়ের ভেতর সেগুলো দুর করে সফলভাবে সম্পুর্ণ সিস্টেমকে কাজ করানো একটি চ্যালেঞ্জ। তবে তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে তাঁরা পারবেন।ভবিষ্যতে এই প্রকল্পে ক্যামেরাকে ঘোরানো ছাড়াও অটোফোকাস, জুম ইত্যাদি সুবিধা যোগ করা হবে।এমনকি ছবি প্রক্রিয়া করার প্রযুক্তিও এতে যোগ করতে চান নির্মাতারা।বিস্তারিত জানা যাবে http://wsnsurv.googlepages.com ঠিকানার ওয়েবসাইট থেকে।