তথ্য প্রযুক্তির মহাসমুদ্রে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালের দিকে। তখন ইন্টারনেটে সংযুক্ত হবার একমাত্র উপায় ছিল ডায়ালআপ প্রযুক্তি। স্যাটেলাইট সিস্টেমের মাধ্যমে বহুপথ ঘুরে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হবার এ পদ্ধতি একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অপর দিকে ধীর গতি সম্পন্ন। ডায়াল আপ প্রযুক্তির পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তিও এদেশে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। কিন্তু কানেকশন রেট এবং মাসিক বিলের পরিমান বেশি হওয়াতে এই প্রযুক্তি শুধু অফিস পাড়া ও অভিজাত এলাকাতেই জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে আইসিটি’কে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। প্রযুক্তিময় এ বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে অনেক দেশই তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। ইন্টারনেট পরিসেবা সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বাংলাদেশের নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে দরকার সুস্পষ্ট নীতিমালা। বাংলাদেশে ইন্টারনেট খুব বেশিদিন আগে না আসলেও বর্তমানে দিন দিনই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে এর ব্যবহার এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা। যদিও বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সুনির্দিষ্ট নয়, তবুও এ সংখ্যা দশ লাখ বলে অনুমেয়। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) কর্তৃক আইএসপি লাইসেন্স প্রদান করা হয় প্রায় ১৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু লোকাল সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে পরিচিত নন-লাইসেন্স আইএসপিগুলোর ব্যবসা পরিচালনার কারণে লাইসেন্সকৃত আইএসপি প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে। ইন্টারনেট সেবা বাংলাদেশে এখনো সর্বত্র তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম। কেননা, ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলো ব্যতিত ইন্টারনেট অবকাঠামো এখনও তেমনভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। দেশে ব্রডব্যান্ড একসেস সস্তা হওয়ার মানে দেশে আইটি ব্যবহারকারীর পরিমাণ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া। আমাদের সরকারের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরী যাতে জনগন কম মূল্যে এবং বেশি হারে ব্রডব্যান্ড সেবা পায়, এতে দেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর সি-মি-উই-৪ সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এর কোন ব্যাকআপ নেই। ফলে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট যোগাযোগ রাখতে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনো ভিস্যাটের উপর নির্ভর করতে হয়। যার বড় প্রমাণ মাঝে মাঝেই দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্কের ফাইবার অপটিক ক্যাবল কাটা পড়ায় আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ও ইন্টারনেট সেবা হঠাৎ করে ধসে পড়ে। এ সময় ভিস্যাটের মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতিতে এসব সেবা চালু রাখতে হয়। সাবমেরিন নেটওয়ার্ক সংযোগ পেতে আমাদের সময় লেগেছে ১৪ বছর তারপরও এটি এখনো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আর দূরমূল্যের কারণে জনসাধারণের নাগালের মধ্যে আসতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কর্তৃক সারাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যান্ডউইডথ চার্জ প্রায় ৬০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত দেশে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতে চলেছে। ফলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ অতি সহজে এবং স্বল্পমূল্যে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ডায়াল-আপ প্রযুক্তির পরিবর্তে ব্যাপকভাবে জায়গা করে নিয়েছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রযুক্তি। সেই সাথে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। যদিও ওয়াইম্যাক্স-এর সুফল উপভোগ করতে আমাদের বেশকিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ব্রডব্যান্ডের বিস্তার এবং সেবার মানের উন্নয়নের ফলে গ্রাহক পর্যায়ে পূর্বের তুলনায় ডায়াল-আপ এর চাহিদা ক্রমাবনতি লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী বিভিন্ন পিএসটিএন অপারেটরসমূহ এবং নবগঠিত বিটিসিএল কর্তৃক ফোনের কানেকশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা গ্রাহক পর্যায়ে ডায়াল-আপ ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকে পূর্বের তুলনায় অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুমানিক দশ লক্ষ। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্র বৃদ্ধি এবং সেবার সহজলভ্যতা ইতোমধ্যেই গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী সংস্থা আইএসপি এসোসিয়েশন-এর সভাপতি আবদুস সালাম জানান, ‘দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে আমরা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহক সেবা প্রদান করতে চলেছি। এর মাধ্যমে একই বিল্ডিংয়ে ব্রডব্যান্ড কানেকশনের মাধ্যমে চার-পাঁচজন গ্রাহক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ গ্রহণ এবং ব্যবহার করতে পারবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রায় ৩০ লক্ষ কম্পিউটার এবং ১০ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। আমরা আশা করছি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা যেভাবে বিস্তৃত হয়ে চলেছে তাতে অচীরেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অতি দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে দেশে বিভিন্ন শহরে লাইসেন্স বিহীন আইএসপি প্রতিষ্ঠান যারা কোন বৃহৎ আইএসপি প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে সংযোগ গ্রহণের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট এলাকায় স্বল্পপরিসরে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে চলেছে তাদেরকে সুনির্দিষ্ট লাইসেন্সিং গাইড লাইনের মাধ্যমে আনতে সক্ষম হলে গ্রাহক পর্যায়ে সেবার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এবং গ্রাহকরা স্বল্পমূলে দ্রুত গতির ব্রডব্যান্ড সেবা ব্যবহার করতে পারবে। দেশে ১৭৯টি আইএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা দেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানে নিয়োজিত রয়েছে। দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে অচীরেই ডায়াল-আপ প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সংখ্যা হ্রাস করবে নিঃসন্দেহে। প্রযুক্তির বিকাশের ধারাবাহিকতায় অদূর ভবিষ্যতে ডায়াল-আপ প্রযুক্তির বদলে বেশিরভাগ মানুষই ব্রডব্যান্ড এবং ওয়াইম্যাক্স-এর আওতায় চলে আসবে।’ দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর বেশিরভাগ মানুষের নিকট ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করে তুলতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের চাহিদা দিন দিনই বাড়ছে। যদিও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি জ্ঞানের আঁধার হিসেবে স্বীকৃত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা উচ্চমূল্যের দরুণ বাংলাদেশে অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এই না বাড়ার কারণ হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনেকেই চিহ্নিত করছেন ইন্টারনেট অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্বল্পতা এবং ব্যবহারের উচ্চমূল্যের বিষয়টিকে যদিও সরকার বেশকিছুদিন পূর্বে ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইডথ-এর মূল্য পূর্বের তুলনায় অনেক হ্রাস করেছে। যা দেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী আইএসপি প্রতিষ্ঠানসমূহকে সুযোগ করে দিয়েছে স্বল্পমূল্যে দ্রুতগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা ব্যবহারকারী পর্যায়ে পৌঁছে দিতে। শীর্ষস্থানীয় ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিডিকম লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন আহমেদ সাব্বির বলেন, ‘বর্তমানে বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় আইএসপি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অপটিক সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে ব্রডব্যান্ড সেবা দিচ্ছে। নিজেদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি দ্রুতগতি সম্পন্ন ব্রডব্যান্ড সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ইতোমধ্যে দেশের ডায়াল-আপ ইন্টারনেট ব্যবহারের তুলনায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারের চাহিদা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যদিও আমি মনে করি, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা যতোদিন পর্যন্ত আমরা না পৌঁছাতে সক্ষম হবো ততোদিন পর্যন্ত দেশে ডায়াল-আপ ইন্টারনেট ব্যবহারের চাহিদা থাকবে। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ সত্যিকার অর্থে ব্যবহারকারীদের কল্যাণে সবসময় কাজ করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ডায়াল-আপ ইন্টারনেট ব্যবহারের স্থানে ব্রডব্যান্ড এবং অদূর ভবিষ্যতে ওয়াইম্যাক্স নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে প্রযুক্তির মানউন্নয়ন এবং স্বল্পমূলে দ্রুতগতির সেবা প্রদানের মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে এবং এই শিল্প প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার। ব্রডব্যান্ডের সহজলভ্যতা এবং সেবার মূল্য পূর্বের তুলনায় হ্রাস পাওয়ায় এই শিল্পে বিভিন্ন পিএসটিএন, নব গঠিত বিটিসিএল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করার মাধ্যমে ব্যবসাতে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে যাকে আমি সাধুবাদ জানাই। কেননা, এর মাধ্যমেই মূলত গ্রাহক পর্যায়ে সত্যিকার অর্থে দ্রুতগতিসম্পন্ন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে।’ ইতোপূর্বে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলেও এবারের এই উদ্যোগ সফল করতে দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সুষ্ঠু নীতিমালার আওতায় বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ব্যান্ডউইডথ-এর মূল্য কমানোর ফলে ইন্টারনেট সেবা এখন সকলের নাগালের মধ্যে এসেছে। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট শিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সুষ্ঠুনীতিমালার আওতায় আইএসপি প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিযোগিতামূলক দ্রুতগতিসম্পন্ন ব্রডব্যান্ডের সেবা বিস্তারের মাধ্যমে অচীরেই বাংলাদেশে ইন্টারনেট অধিকসংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে নিশ্চিতভাবে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি এই সুবিধা দেশের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। ফলে দেশের সকল স্থানে বসবাসকারী ব্যক্তিরা পূর্বের তুলনায় দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে সক্ষম হবে এবং ক্রমান্বয়ে স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করে তুলতে সরকারি-বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানসমূহকেই এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বিস্তার বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে প্রবেশের যথার্থতা প্রমাণে সহায়তা করবে।