মাইক্রোসফট-এর নতুন অপারেটিং সিস্টেম
মাইক্রোসফটের নতুন সিইও স্টীভ বালমার এ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো মাইক্রোসফট নতুন কোন উইন্ডোজ সংস্করণ বাজারে ছাড়ার কথা ঘোষণা করল। স্টীভ বালমার ভেতরে ভেতরে কতটা উত্তেজিত ছিলেন তা জানা না গেলেও সারা বিশ্বের কোটি কোটি উইন্ডোজ ভক্তকে উত্তেজনায় ভাসিয়ে গত ৭ জানুয়ারি আমেরিকার লাস ভেগাস থেকে ঘোষণা করলেন, মাইক্রোসফট নিয়ে আসছে নতুন বছরে নতুন অপারেটিং সিস্টেম যার নাম ‘উইন্ডোজ সেভেন’। লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স শো এ মূল আকর্ষণ ছিল উইন্ডোজ ৭। এ অনুষ্ঠানে বালমার বলেন, ‘আমরা উইন্ডোজের সবচেয়ে ভাল ও উন্নত সংস্করণটি এবার উপস্থাপন করছি। এই সংস্করণের উপাদান হল: সহজ-সাধারণ, নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুতগতি।’ মূলত উইন্ডোজ ভিসতার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেই উইন্ডোজ ৭’কে ঢেলে সাজানো হয়েছে।
উইন্ডোজ ৭ বেটা সংস্করণ
মাইক্রোসফট নতুন অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ৭ এর পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ এখনও বাজারে ছাড়েনি। মাইক্রোসফট তার প্রোডাক্টের প্রতি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রথমে ইন্টারনেট বেটা সংস্করণ বিনামূল্যে অবমুক্ত করে। বেটা সংস্করণে পূর্ণাঙ্গ সংস্করণের চেয়ে বেশ কিছু ফিচার কম থাকে এবং তা সম্পূর্ণ অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। তবে বেটা সংস্করণ অবমুক্ত করে উইন্ডোজ ভক্ত আর প্রোগ্রামারদের কাছ থেকে সমালোচনা, আলোচনা ও মতামত পাওয়া যায়। সেই সাথে যদি কোন সমস্যা বা ‘বাগ’ পাওয়া যায় তাও সুধরে নেওয়া যায় পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ বাজারে ছাড়ার আগে। এছাড়া ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার একটা উপায়ও হল বেটা সংস্করণ অবমুক্তকরণ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বেটা সংস্করণ অনলাইনে বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও এটি মূলত মাইক্রোসফটের একটি ব্যবসায়িক কৌশল ও লাভ হিসাবের ক্ষেত্র। ইন্টারনেট থেকে যে কেউ এই বেটা সংস্করণ বিনামূল্যে ডাউনলোড করে উইন্ডোজ ৭ এর কিছু ফিচার উপভোগ করতে পারবে। উইন্ডোজ ৭ বেটা সংস্করণ ডাউনলোড করার লিংক এড্রেস হল : www.microsoftcom/windows/windows-7/defaultaspx
উইন্ডোজ সেভেনের নতুন ফিচার
যারা উইন্ডোজ ভিসতা ব্যবহার করেছেন তাদের জন্য উইন্ডোজ সেভেনের কিছু কিছু গ্রাফিক্যাল ফিচার পুরানো মনে হতে পারে। আসলে উইন্ডোজ ভিসতার কার্ণেলকে ভিত্তি করেই উইন্ডোজ সেভেন তৈরি করা হয়েছে। স্টার্ট মেন্যু হিসেবে পুরানো ভিসতার গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেসটিই ব্যবহার করা হয়েছে। তবে হতাশ হবেন না রয়েছে অতি দ্রুত গাতির সার্চ ইঞ্জিন। হার্ড ডিস্কের আকার যত বড়ই হোক, এক সেকেন্ডের মধ্যে যেকোন ফাইল খুঁজে বের করতে সক্ষম এই সার্চ ইঞ্জিন। টাস্কবারটি উন্নত করা হয়েছে অনেক। কুইক লাঞ্চ ফিচারের পরিবর্তে টাস্কবারের মধ্যেই প্রোগ্রাম আইকন যা ওপেন করলে সেখানেই থেকে যায়। তবে আকারে অনেক বড় ও ডিটেইলস বিবরণসহ দেখায়। চালু থাকা যেকোনো উইন্ডো বা প্রোগ্রামের টাস্কবার আইকনে মাউসটি নিয়ে গেলে পুরো উইন্ডোটি একসাথে দেখা যায়। বাকী উইন্ডোগুলো পুরো অদৃশ্য হয়ে যাবে সেই মুহূর্তে। এর ফলে সহজেই উইন্ডো থেকে টাস্কবারের কাজগুলো একসাথে দেখে নিতে পারবেন। আবার কোন উইন্ডো কি কাজ করছে তাও সহজে বুঝতে পারবেন। এর ফলে মাল্টিটাস্কিং কাজগুলোর ক্ষেত্রে সময় বাঁচিয়ে কাজ করতে পারবেন স্বাচ্ছন্দ্যে।
আরো রয়েছে জ্যাম্প লিস্ট যা টাস্কবারের একটি বর্ধিত ফিচার। টাস্কবারে আপনি কোন ওয়ার্ড প্রোগ্রাম সচল থাকলে কেবল রাইট মাউস ক্লিক করেই সাম্প্রতিক সময়ে করা ডকুমেন্টের বিবরণ পেয়ে যাবেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় ফাইলকে পিন করে রাখা যাবে যাতে প্রয়োজনের সময়ে ডেস্কটপের উপরেই ফাইলটি পেয়ে যান। ভিসতার পুরানো একটি ফিচার ‘ভিউ ডেস্কটপ’ নতুনরূপে নিয়ে আসা হয়েছে যা টাস্কবারের পাশেই অবস্থান করে। বেশকিছু নতুন পুরানো গ্যাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে উইন্ডোজ সেভেনে। ডেস্কটপের যেকোন স্থানে রেখে আপনি গ্যাজেটগুলো ব্যবহার করতে পারবেন।
ইন্টারনেট কানেকশন ফ্যাসিলিটি অনেক উন্নত করা হয়েছে উইন্ডোজ সেভেনে। ভিসতার সাথে রয়েছে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের সর্বশেষ সংস্করণ ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৮। আগের যে কোন সংস্করণের চেয়ে দ্রুতগতির, উন্নত এড্রেসবার, সার্চ বার, ফেভারিট বার ইন্টারনেট সার্চিংকে আরো সহজ করে দেবে। সার্চবারে ইচ্ছামতো সার্চ প্রোভাইডার বা সাইট ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে। এছাড়া এক্সপ্লোরার ৮-এ রয়েছে ইন্সট্যান্ট সার্চ সুবিধা। এর মাধ্যমে সার্চবারে কিছু লেখা শুরু করার সাথে সাথেই সংশ্লিষ্ট সার্চ রেজাল্টের ফলাফল বা সাজেশন চলে আসতে থাকবে। এর সাথে আছে দ্রুতগতিতে সহজে ম্যাপ থেকে যে কোন কিছু বের করার জন্য এক্সেলারেটর। আর সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিয়ে আসা হয়েছে ‘ওয়েব াইস’ নামে একটি অপশন। এর ফলে বিভিন্ন সাইটকে ট্যাবের মধ্যে রেখে কাজ করতে পারবেন। আরো আছে উইন্ডোজ লাইভ সার্ভিস। উইন্ডোজ সেভেনে স্বভাবতই মাইক্রোসফট তার নিজস্ব লাইভ সার্ভিসগুলোকে আরো উন্নত ও ভালভাবে উপস্থাপন করতে বদ্ধপরিকর। এই লাইভ ম্যাসেঞ্জার প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে লাইভ ম্যাসেঞ্জার, ফটো গ্যালারি, মেইল, রাইটার, মুভি ম্যাকার ইত্যাদি সহ আরো অনেকগুলো ইন্টারনেট সার্ভিস। এক কথায় বলা যায় ভবিষ্যত ও বর্তমানের ইন্টারনেট ব্যবহার জনপ্রিয়তা উপলব্ধি করতে পেরে মাইক্রোসফট পেয়েছে উইন্ডোজ সেভেনকে সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ফ্রেইন্ডলি করে উপস্থাপন করতে।
সমস্যা সমাধান
ভিসতায় একটি ভয়াবহ সমস্যা ছিল যার নাম ‘ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট’। নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত ছিল ভিসতার ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট। প্রিন্টার সেটআপ, মোবাইল ড্রাইভ, ক্যামেরা কালেকশনের ক্ষেত্রে ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট একটি বিরক্তিকর ফিচার ভিসতায়। কিন্তু উইন্ডোজ সেভেনে নিয়ে আসা হয়েছে ডিভাইস স্টেজ নামক নতুন টেকনোলজি। এর মাধ্যমে পিসির সাথে যে কোন ডিভাইস ঝামেলামুক্তভাবে ও দ্রুতগতিতে সংযুক্ত করে ‘প্লাগ এন্ড প্লে’ পদ্ধতিতে সরাসরি চালানো যাবে। কন্ট্রোল প্যানেলে ‘ডিভাইসড এন্ড প্রিন্টার’ অপশনের ভেতরে পিসির সাথে সংযুক্ত সকল ডিভাইস ও পেরিফেরালস সম্পর্কে বিষদ বিবরণ পাবেন। ‘ডিভাইস ড্রাইভার ইস্যু’ নামে একটি অপশন পাবেন যার মাধ্যমে যেকোন ডিভাইস ড্রাইভারও সহজেই ইন্সটল করতে পারবেন। আর সাউন্ড কার্ড, গ্রাফিক্স কার্ড, নেটওয়ার্ক কার্ড ইত্যাদির জন্য রয়েছে উইন্ডোজ সেভেনের নিজস্ব ড্রাইভার। এ ধরনের কোন সেন্ট্রাল পিসি কার্ড ইন্সটল করাও এখন ‘প্লাগ এন্ড প্লে’-এর মতো হয়ে গেছে উইন্ডোজ সেভেনে।
ফাইল শেয়ারিং প্রক্রিয়াটিও ঝামেলামুক্ত ও সহজ করা হয়েছে। এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে হোম গ্রুপ নামে নতুন একটি ফিচার। এই ফিচারের মাধ্যমে সহজেই একটি লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক ডিজাইন করা সম্ভব। আর নেটওয়ার্কের মধ্যে প্রিন্টার, স্ক্যানার বা ওয়্যারলেস ডিভাইস সহজে সংযুক্ত করতে পারবেন।
মিডিয়া প্লেয়ার ও অন্যান্য টুলস
উইন্ডোজ সেভেনের মিডিয়া প্লেয়ার হল মিডিয়া প্লেয়ার ১২। এখন পর্যন্ত যদিও প্রি-বেটা সংস্করণে সংযুক্ত রয়েছে মিডিয়া প্লেয়ার লাইট, তারপরেও মিডিয়া প্লেয়ারের ফাইলগুলো অর্গানাইজিং সিস্টেম বা লাইব্রেরী আগের চেয়ে উন্নত করা হয়েছে। গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেসেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। অবশ্য আইকন আকারের ভিডিও ফাইলগুলো ভিসতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
মাইক্রোসফটের একটি টুলস ওয়ার্ড প্যাডে নিয়ে আসা হয়েছে রীতিমত বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের .ফড়পী নিয়ে আগে অনেক সমস্যায় পড়তে হত। এবার উইন্ডোজ সেভেনের সাথে যে ওয়ার্ড প্যাড রয়েছে .ফড়পী ফাইল ওপেন করে কাজ করার সুযোগ। এছাড়া ওয়ার্ড প্যাডের মধ্যেই গ্রাফিক্যাল কাজ করার সুবিধা থাকবে।
মাইক্রোসফট পেইন্ট টুলের কথা যদি বলি, তাহলে বলব যে কোন প্রফেশনাল ইমেজ সফটওয়্যারের মতোই শক্তিশালী করা হয়েছে একে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছে থার্ড পার্টি ইমেজ এডিটিং সফটওয়্যারগুলোর দিন শেষ করতেই মাইক্রোসফট এ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ক্যালকুলেটরও আধুনিক করা হয়েছে তবে প্রি-বেটা সংস্করণ অবস্থায় রয়েছে।
উইন্ডোজ সেভেনের ভাষা
উইন্ডোজ সেভেন পৃথিবীর সবগুলো প্রধান ভাষায় বের করার চেষ্টা করবে মাইক্রোসফট। তবে বেটা সংস্করণে অল্প কয়টি ভাষায় একে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আরবী আরবী
ইংরেজি ইংরেজি
জার্মান জার্মান
জাপানি হিন্দী
জাপানি
বাংলায় উইন্ডোজ সেভেনের পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ আসবে কিনা তা অবশ্য এমনও জানা যায়নি। বাংলাভাষা পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম ভাষাভাষী ভাষা। হয়ত বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে মাইক্রোসফট বাংলাকে উপেক্ষাও করতে পারে।
সিস্টেম রিকোয়ারমেন্ট
সিস্টেম রিকোয়ারমেন্ট হল উইন্ডোজ ভিসতা চালাতে আপনার কি ধরনের কম্পিউটার প্রয়োজন হবে তার লিস্ট। উইন্ডোজ সেভেন একটি উচ্চ গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস যুক্ত অপারেটিং সিস্টেম। এ জন্য অবশ্যই প্রসেসর ও মেমোরি ভাল হতে হবে। দেখে নিন কি ধরনের সিস্টেম রিকোয়ারমেন্ট প্রয়োজন উইন্ডোজ ৭ এর জন্য :
প্রসেসর : পেন্টিয়াম ৪, ১ গিগাহার্জ ৩২ বিট বা ৬৪ বিট প্রসেসর।
র্যাম : ১ গিগাবাইট
হার্ডডিস্ক : ১৬ গিগাবাইট (উইন্ডোজ সেভেন সেটআপ করার জন্য)
ভিডিও ও গ্রাফিক্স সাপোর্ট : ডাইরেক্ট এক্স৯ গ্রাফিক্স সাপোর্ট সাথে ১২৮ মেগাবাইট মেমোরি
রিড/রাইট ড্রাইভ : ডিভিডি (রিড/রাইট) ড্রাইভ
ইন্টারনেট সংযোগ : প্রয়োজনীয় ডাউনলোডের জন্য।
সৌজন্যে : দৈনিক ইত্তেফাক



