ইন্টারনেটে ডিজিটাল বইয়ের ধারণা সারা বিশ্বে বেশ জনপ্রিয় অনেক দিন থেকেই। বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকেই এমন বই পেতে পারে গ্রাহকেরা। সহজ এই সুবিধার ফলে ইন্টারনেটে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল গ্রন্থাগার, যেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ। আমাদের দেশে ডিজিটাল বই সহজলভ্য নয়। তবে এবার খুব ভালো একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের (প্রথম থেকে নবম শ্রেণী) পাঠ্যবইগুলোকে ডিজিটাল করে ইন্টারনেটে প্রকাশ করেছে। শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো মুদ্রিত বইগুলোর মতোই ডিজিটাল সংস্করণ এখন বিনা মূল্যে ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে।

ডিজিটাল মাধ্যমে পাঠ্যবই
প্রতিবছরের শুরুতেই নতুন বইয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা যায়। বছরের শুরুতে মুদ্রিত বই সব শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেওয়া বেশিরভাগ সময়ই সম্ভব হয় না।আর দেশের শিক্ষার্থীরা নতুন বছরে নতুন শ্রেণীর বই পেলেও প্রবাসী বাঙালিরা এ সুবিধা সহজে পায় না।বইগুলোকে ডিজিটাল করার ফলে সেই সুবিধা এখন হাতের নাগালে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল উদ্দিন এ ব্যাপারে বলেন, ‘ডিজিটাল বই হওয়ার ফলে দেশে-বিদেশে পাঠ্যবই পাওয়া এখন অনেক সহজ হবে। আগে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে দেরি হতো। বিশেষ করে বিদেশে প্রবাসী শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দিতে বেশ বেগ পেতে হতো। এখন সারা বছর ইন্টারনেটে বইগুলো থাকবে। যার যখন ইচ্ছা ইন্টারনেট থেকে বইগুলো নামিয়ে নিতে পারবে। এই পদ্ধতির ফলে অনেক ছেলেমেয়ে উপকৃত হবে।’
ইন্টারনেটে ডিজিটাল বই প্রকাশ করার পরই এনসিটিবির ওয়েবসাইট ব্যবহারের হার অনেক গুণ বেড়ে গেছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, এই যে একবার ডিজিটাল বইগুলো ইন্টারনেটে রাখা হলো, এরপর শুধু নতুন সংস্করণের সময় কিছু পরিবর্তন করলেই চলবে। মূল কাজটা এবার হয়ে গেল।’
প্রথম থেকে নবম শ্রেণীর মোট ৮৩টি বই এখন ইন্টারনেটে রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বই যুক্ত হবে। পাঠ্যবইগুলো ডিজিটাল হলেও এখন তা শুধু ইন্টারনেটে রাখা হয়েছে। সিডি আকারে এ বইগুলো প্রকাশ করার পরিকল্পনা আপাতত নেই বলে জানা গেছে।
যেভাবে হলো
এবারই প্রথম প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠ্যবই ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এই ডিজিটাল বইগুলো প্রকাশ করেছে।মুদ্রিত বইকে ডিজিটাল সংস্করণে রূপান্তরের কাজটি করেছে এইচএসটিসি লিমিটেড নামের একটি দেশি প্রতিষ্ঠান। ‘২০০২ সাল থেকে আমাদের দেশে একটি ডিজিটাল গ্রন্থাগার গড়ার চিন্তা মাথায় রেখে কাজ শুরু করি। সে জন্য শুরুতে আমরা সরকারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সব বইকে ডিজিটাল করার এই কাজটি হাতে নিই’—বললেন এইচএসটিসি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম শোয়েব চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানটি এনসিটিবির প্রকাশিত বইয়ের হুবহু ডিজিটালসংস্করণ পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরম্যাটে (পিডিএফ) তৈরি করা হচ্ছে বলে জানালেন শোয়েব চৌধুরী।

ডিজিটাল বই পাওয়ার উপায়
এনসিটিবির নিজস্ব ওয়েবসাইটে রাখা ডিজিটাল বই সহজেই নামিয়ে নেওয়া যাবে। এই বই নামিয়ে নিতে www.nctb.gov.bd ঠিকানার ওয়েবসাইটে গিয়ে টেক্সটবুক উইং নির্বাচন করতে হবে। এবার ডাউনলোড উইং থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অথবা মাধ্যমিক শিক্ষা নির্বাচন করে বিভিন্ন শ্রেণী অনুযায়ী বই নামানো যাবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটি বই আলাদাভাবে নামিয়ে নেওয়া যাবে সহজেই। ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে বইয়ে ব্যবহূত ফন্ট ও পিডিএফ সুবিধাও পাওয়া যাবে এই সাইটে। সহজে ব্যবহারের জন্য এই সাইটের ডান পাশে প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদসহ রয়েছে বই নামানোর লিংক। ব্যবহারকারীরা প্রয়োজনে এখান থেকে বই নির্বাচন করেও নামিয়ে নিতে পারবেন। বই নামানোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা কিংবা পরামর্শ সাইটের ফিডব্যাক অপশনে পাঠানো যাবে।

ডিজিটাল বই এবং প্রত্যাশা
প্রথমবারের মতো ডিজিটাল বইয়ের এই প্রকাশকে বিশেষভাবে দেখছে অনেক ব্যবহারকারী। বই ইন্টারনেটে রাখার পরপরই পঞ্চম শ্রেণীতে সদ্য উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী রাকিব আহমেদ নামিয়েছে নিজের সবগুলো বই। তার বাবা রাশেদ আহমেদ পিডিএফ আকারের এই বই নামিয়ে পুরো বই আকারে বাঁধিয়েও এনেছেন। ছাপানো বইয়ের বাইরে এবারই প্রথম এ ধরনের বই পেয়ে উল্লসিত রাকিব জানাল তার ভালো লাগার কথা। নতুন শ্রেণীতে অন্য রকম নতুন বই নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত সে—জানালেন তার মা জাহানারা বেগম। ঘরে বসেই এমন সুবিধা পেয়ে খুশি তারা। ‘ইন্টারনেটে বইগুলো রাখার পর থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন-চার হাজার বই নামানো হচ্ছে।’ —জানালেন শোয়েব চৌধুরী। নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটটি এত বেশিবার দেখা হচ্ছে যে, অনেক সময়ই এর গতি খুব ধীর হয়ে যায়। এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, ওয়েবসাইটটির গতি ঠিক রাখার জন্য ব্যান্ডউইডথবাড়ানো হবে।

প্রয়োজন ইন্টারনেট আর প্রশিক্ষণ
ডিজিটাল বইকে জনপ্রিয় ও কার্যকর করতে অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে—অনেকেই এমনটা মনে করেন।প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের যত বেশি ইন্টারনেটের আওতায় আনা যাবে, তত বেশি বাড়বে ডিজিটাল বইয়ের ব্যবহার। সারা বিশ্বে ডিজিটাল বই ব্যবহূত হয় নানাভাবে এবং শুধু ডিজিটাল বইয়ের জন্যও রয়েছে বেশ কিছু ডিজিটাল মাধ্যম। ডিজিটাল মাধ্যমে ডিজিটাল বইয়ের এই শুরুটা বাড়ানো যায় নানাভাবে। শুধু টেক্সট বই নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত করা যায় মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তি।বর্তমানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের সিডি কিংবা ডিভিডি ব্যবহারের মাধ্যমে শিখছে শিক্ষার্থীরা। ডিজিটাল বইয়ের এই সুবিধার সঙ্গেও এ ধরনের আয়োজন যুক্ত করা সম্ভব বলেমনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।


এগিয়ে যাওয়ার পথে
ডিজিটাল মাধ্যমে ডিজিটাল বইয়ের এই সুবিধা ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে অনেকখানি। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাছাকাছি এই সুবিধা পৌঁছাতে প্রয়োজন ইন্টারনেট, যা সবার দ্বারে দ্বারে পৌঁছাতে হবে।